আপনার সন্তানটিকে কি আপনি অলরাউন্ডার হিসেবে দেখতে চান?

আপনার সন্তানটিকে কি আপনি অলরাউন্ডার হিসেবে দেখতে চান? তাহলে ছোট থেকেই যত্ন নিন ওর মোটর এবং কগনিটিভ স্কিলের ওপর।

বাচ্চার মোটর স্কিল ও কগনিটিভ স্কিলের উন্নতি কিভাবে করবেন?

সুনন্দার মেয়ে দোয়েলের পড়াশোনা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। খুব আগ্রহ নিয়েই সে লেখাপড়া করে। ক্লাসে ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। কিন্তু একটাই সমস্যা তার, সেটা তার হাতের লেখা। এই নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়তে হয় তাকে।

নীলাভ প্রতি সপ্তাহে আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফ্টের ক্লাস থাকলে স্কুল যেতে চায়না। একেবারেই রপ্ত করতে পারে না ড্রইং বা আঁকাঝোকার কাজ। ক্লাসে এ ব্যাপারে গ্রেডেরও অবনতি হচ্ছে তার।

ওপরের সমস্যারগুলোর সম্মুখীন অনেকেই হন প্রতিনিয়ত। আর এগুলোর জন্য বাচ্চাদের দরকার মোটর স্কিলের উন্নতি।

মোটরস্কিল আসলে কী?

মোটরস্কিল এমন একটি প্রক্রিয়া যা আমাদের পেশী বা মাসল সংক্রান্ত কাজ করতে সাহায্য করে। মোটরস্কিল সাধারনত: দুধরণের হয়-

  • গ্রস মোটর স্কিল
  • ফাইন মোটর স্কিল

গ্রস মোটরস্কিল আমাদের শরীরের বড় পেশীগুলোকে সঞ্চালনে সাহায্য করে, যেমন- হাত, পা পায়ের পাতা ইত্যাদি। ফাইন মোটরস্কিল আঙুলের পেশী সঞ্চালনে সাহায্য করে। বিভিন্ন সূক্ষ্ম কাজ যেমন আঁকাঝোকা, সেলাই , আল্পনা দেওয়া এসব কাজের জন্য খুবই দরকার ফাইন মোটরস্কিলের উন্নতি। খুব ছোটবয়স থেকে বাবা মা রা যদি এ বিষয়ে সচেতন হন, অবশ্যই ভালো ফল পাওয়া যাবে।

বাচ্চাদের গ্রস মোটরস্কিলের উন্নতি কিভাবে করবেন?

  • বাচ্চাদের নিয়মিত আউটডোর গেম খেলার সুযোগ দিন। বাচ্চা ছোট হলে নিজেরা থাকুন মনিটরিং করার জন্য। খোলা মাঠে খেলাধূলো করার কোনো বিকল্প নেই মোটরস্কিল উন্নত করতে।
  • বিভিন্ন ধরনের ব্যালান্সিং গেম খেলতে দিন বাচ্চাকে। যেমন দড়ির স্লাইডে ওঠানামা করা, মিউসিক্যাল থ্রো-ক্যাচ গেম খেলা ইত্যাদি।
  • এমন কিছু খেলার আয়োজন করুন যাতে বাচ্চাকে বিভিন্ন ধরণের অ্যাক্টিভিটির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেমন ট্রেজার হান্ট জাতীয় খেলা এসব ক্ষেত্রে বেশ উপযোগী।

বাচ্চার ফাইন মোটর স্কিলের উন্নতি কিভাবে করবেন?

  • বাচ্চাকে বিভিন্ন ধরনের প্লে ডো কিনে দিন। আটা ময়দার লেচি কেটেও দিতে পারেন। বাচ্চাকে উৎসাহ দিন সেসব দিয়ে কিছু বানানোর জন্য। বাচ্চারা খুবই খুশী হয় এসব খেলার সামগ্রী পেলে।
  • বাড়ীতে লেখালিখি করার জন্য শুধু খাতা পেন্সিল নয় ব্ল্যাকবোর্ড-চক কিনে দিন। বাচ্চা শুধু যে লিখতে উৎসাহ পাবে তা নয় বরং ওর হাতের গ্রিপিং পাওয়ার উন্নত হবে যা প্রকৃতপক্ষে ফাইন মোটর স্কিলকে ডেভেলপ করে।
  • আজকাল বাচ্চাদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের কাঁচি পাওয়া যায়। তা দিয়ে বাচ্চাদের কাগজ কাটতে বলুন। এ কাজ ওরা খুব আনন্দের সাথে করবে। সাথে তৈরী হবে ওদের হাতের সূক্ষ্ম বা ফাইন ব্যালান্স।
  • বিভিন্ন ধরনের সর্টিং গেম খেলুন বাচ্চাদের সাথে। একটা বাটিতে রাজমা ছোলা মিশিয়ে সেগুলোকে আলাদা করতে। অথবা খেলুন ‘পিক আপ দ্য স্টিক ক’ খেলা।  আঙুলের ওপর কন্ট্রোল বাড়ে এই ধরণের খেলায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফাইন মোটর স্কিল ভাল হয়।
  • বাড়ীতে বাচ্চাদের স্পুন বা ফর্কে খাওয়ান অভ্যাস করান। নুডলস খাওয়ার সময় চপস্টিক্স ব্যবহার করতে পারলে তো কথাই নেই। এটা শুধু টেবিল ম্যানার্সের জন্য নয়, ফাইন মোটরস্কিলের জন্যও।
  • বাচ্চাকে যত ইচ্ছে কালার করতে দিন। ফিংগার পেন্টিং করলে তো কথাই নেই। মনসংযোগের সাথে তরতরিয়ে উন্নতি হবে ফাইন মোটর স্কিলের।
  • জামার বা সোয়েটারের বড় বড় বোতাম বাচ্চাকে নিজেকে খুলতে উৎসাহ দিন।

এসব অ্যাক্টিভিটি গুলো বাচ্চাদের মনকে অনেক বেশী ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল করে তোলে। বাচ্চার ফাইন মোটর স্কিলের উন্নতিও হয়। ফলস্বরূপ বাচ্চার হাতের কাজ বা হ্যান্ডরাইটিং র উন্নতি হয়।

কগনিটিভ স্কিল:

কনিকার ছোট্ট মেয়ে তৃষাকে নিয়ে ওর চিন্তার শেষ নেই। ছোট্ট তৃষা সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, কিন্তু কনিকা লক্ষ্য করছে আর পাঁচজন বাচ্চার থেকে ও যেন অনেকটাই পিছিয়ে। আশেপাশে কী ঘটছে বা ক্লাসে কী ধরনের ইনস্ট্রাকশন ম্যাডাম ফলো করতে বলছেন তার কোনো কিছুই সঠিকভাবে বুঝতে পারেনা তৃষা। এ বিষয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ও জানতে পারে তৃষার কগনিটিভ পাওয়ার কিছুটা কম।

কগনিটিভ পাওয়ার আসলে কি?

কগনিটিভ পাওয়ার এমন একটি মানসিক প্রক্রিয়া যা আমাদের মনসংযোগ, স্মৃতিশক্তি, বিচারবুদ্ধি, হিসেবনিকেশ, সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রন রাখে। খুব ছোট বয়স থেকে আমরা যদি বাচ্চাদের কগনিটিভ স্কিলের ওপর গুরুত্ব দিই তাহলে দেখা যায় বাচ্চাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার অনেক বিকাশ হয়। ফলত: পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যাপারেও তারা অনেকটাই সাবলীল থাকে।

কগনিটিভ স্কিল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি:

খুব ছোটো বয়স থেকেই বাচ্চার কগনিটিভ স্কিল বাড়ানোর জন্য মা বাবাকে যত্নশীল হতে হবে।

  • বাচ্চাকে গান গেয়ে শোনান এবং ওকে উৎসাহ দিন আপনার সাথে গান গাওয়ার জন্য। ওর পছন্দসই গান রোজই চালিয়ে ওকে শোনান। দেখবেন, কিছুদিনের মধ্যে ও নিজেই গুনগুন করে গানটি গাওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে নতুন নতুন শব্দের সাথে বাচ্চার পরিচয় ঘটে আবার স্মৃতিশক্তিও বাড়ে।
  • বাচ্চাকে বিভিন্ন রকম শব্দ আলাদা করে চিনতে সাহায্য করুন। কোনটা কাকের ডাক, কোনটাই বা প্রেসার কুকারের শব্দ তা ওকে বোঝান। এর ফলে ওর চারপাশের সবকিছুর সাথে পরিচিতি ঘটবে।
  • বাচ্চাকে অক্ষর ও কাউন্টিং শেখান খেলাচ্ছলে। এখন বিভিন্ন রকম ইনডোর গেমস বেরিয়েছে যা বিভিন্ন আনন্দময় উপায়ে বাচ্চাদের অক্ষর শেখায়। সেগুলোর ব্যবহার করতে শেখান।
  • বাচ্চাকে ভালবাসাময় পরিবেশ দিন নতুন কিছু শেখার জন্য। বকাঝকা বা মারধোর করলে কোনোদিনই বাচ্চা আনন্দ করে কিছু শিখবেনা, ফলে কখনই আত্তীকরন হবেনা সেই শেখার।
  • বাচ্চাকে কিছু কিছু বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। ওকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করুন। যেমন খাবার টেবিলে বসে ওকে জিজ্ঞেস করুন ওর আরেকটু ভাত লাগবে কিনা বা ও কোনো ডেজার্ট খেতে চায় কিনা।
  • বিভিন্ন দ্রষ্টব্যমূলক জায়গায় ওকে বেড়াতে নিয়ে যান। বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করুন সে সমন্ধে। ওর সবরকম কৌতুহলী প্রশ্ন মন দিয়ে শুনুন ও উত্তর দেবার চেষ্টা করুন।
  • বিভিন্ন ধরনের পাজল গেম খেলুন ওর সাথে। বিল্ডিং ব্লক বানানোও এক্ষেত্রে খুব উপযোগী।
  • বাচ্চাকে নিয়ম করে এক্সারসাইজ করার দিকে জোর দিন। ব্রেনের ডেভেলপমেন্টের জন্য এক্সারসাইজের একটা বড় ভূমিকা আছে। বাচ্চা যত বেশী খোলা হাওয়ায় খেলাধূলো করবে ততই মাথায় অক্সিজেনের সার্কুলেশন বাড়বে। তত সতেজ থাকবে বাচ্চা।
  • বাচ্চার স্লিপ সাইকেল বা ঘুমের গভীরতা ও পরিমান নিয়ে সচেতন থাকুন। বাচ্চার ৮-১০ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন ও গভীর ঘুমের প্রয়োজন। ঘুমনোর আগে কখনই বাচ্চাকে বকাঝকা করবেন না। এতে তার ইতিবাচক মনোভাবের ক্ষতি হয়। বরং বাচ্চাকে পজিটিভ কথা বলুন, ভাল গল্পের বই পড়ান ঘুমোতে যাবার আগে। বাচ্চাদের মধ্যে সৃজনী ক্ষমতা বাড়তে বাধ্য।
  • বাচ্চার খাওয়া দাওয়া বা ডায়েটের প্রতি সচেতন থাকুন। প্রতিদিন ওদের ডায়েটে ওমেগা-৩ জাতীয় খাবার ( মাছ, ডিম বাদাম ইত্যাদি) রাখার চেষ্টা করুন। এই ধরনের খাবার বাচ্চার মনসংযোগ ও কগনিটিভ স্কিল বাড়ানোর জন্য অব্যর্থ।

Note: The above text is taken from the Bengali parenting book “Bhalo-bashay shaishab” (published from Dey’s Publishing) written by Parenting Consultant Payel Ghosh.