আপনার বাচ্চা কি লাজুক?
পিয়াকে নিয়ে ওর মা বাবার কোনো সমস্যা নেই। শান্ত,লক্ষ্মী মেয়েটা যেমন মিষ্টি স্বভাবের তেমনই নিজের মনে থাকে। কিন্তু ওর সমস্যা একটাই। বাইরের লোকের সামনে সে একেবারেই আড়ষ্ঠ। তখন নিজের নামটা পর্যন্ত কারোর সামনে বলতে চায়না সে। দুদিন বাদে স্কুলে ভর্তি হবে সে। পিয়ার মা বাবার রাতের ঘুম চলে গেছে এই ভেবে যে ইন্টারভিউয়ের সময় কি করবে পিয়া ? হয়ত সে কারোর সাথে কথাই বলল না ওখানে গিয়ে।
আদৌ কি কোনো ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারবে সে?
ইশানকে নিয়ে আবার অন্য সমস্যা। বাড়ীর মধ্যে সারাক্ষণ প্রচুর হইহই করে ছোট্ট ইশান। গান চালিয়ে নাচও করছে সবসময়। কিছুদিন আগে পাড়ার ফাংশনে ইশান নাচ করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ফাংশন শুরু হওয়ার মিনিট দশেক আগে থেকে তারস্বরে কান্না জুড়ল সে। কোনোভাবেই সে সবার সামনে কোনো পারফর্মেন্স করবেনা। অত্যন্ত অপ্রস্তুত ইশানের বাবা মা। হাজার বকে ঝকেও তাকে রাজী করান গেলনা। অগত্যা চিৎকার চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করে বাড়ী চলে এল তারা।
ছোট্ট দোলনের আবার অন্য সমস্যা। সে কারোর সাথে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা। তার সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলা করতেও তার প্রবল আপত্তি। তার মা পার্কে নিয়ে গেলেও সে নিজের মতন একা একা খেলে। এমনকি স্লিপ দোলনাতেও উঠতে চায়না। দোলনের এই ধরণের আচরণে বেজায় চিন্তিত তার মা-বাবা।
যে কটি উদাহরণ দিলাম তা অনেক বাচ্চাদের মধ্যেই দেখা যায়। প্রথমত: একটা কথা সবার আগে জানা দরকার। প্রতিটি বাচ্চাই স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের মধ্যেই আলাদা আলাদা অনুভূতি আছে। তাই সোশাল স্কিল সবার সমান থাকেনা। বাচ্চার মধ্যে যদি অন্যের সাথে মেশবার ক্ষমতা কম থাকে তাহলে তার জন্য অহেতুক চিন্তা করার কোনো কারন নেই। বরং তাকে উৎসাহিত করুন বিভিন্নরকম ভাবে।
‘লাজুক’ বা ‘শাই’ হওয়া কোনো সমস্যা নয়:
অনেক বাচ্চাই অচেনা কাউকে দেখলে বা কারোর সাথে কথা বলতে ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। তাই সেই সময়টুকু তাকে দিতে হবে যাতে সে আত্মবিশ্বাস পায়। আমরা অনেকসময় সবার কাছে তাদের ‘শাই’ বলে চিহ্নিত করি। এটা তাদের কনফিডেন্স আরো কমিয়ে দেয়। তারা আরো খোলসের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করে।
এ প্রসঙ্গে একটি কেস স্টাডির উল্লেখ করি।
চার বছরের শাহিদা একটু লাজুক স্বভাবের ছিল। কারোর সাথে কথা বলা তো দূরের কথা বাড়ীতে অচেনা কেউ এলে ওর মায়ের পেছনে লুকিয়ে পড়ত। ওর মা এক সুন্দর উপায় নিলেন। কেউ এলেই তাদের সামনে শাহিদাকে নিজের কোলে বসিয়ে নিত। কোনো কিছু বলার জন্য ওকে জোর করতেন না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে ওর মা বলতেন, ‘শাহিদার একটু ওয়ার্ম আপ করতে সময় লাগবে’। আস্তে আস্তে শাহিদার মধ্যে সোশাল প্রোটোকল গুলো বোঝার বোধ তৈরী হল। এখন সে দিব্যি সকলের সাথে খুব গল্প করে।
কিভাবে সোশ্যাল করে তুলবেন আপনার বাচ্চাকে?
১। বাচ্চাকে অচেনা পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার সুযোগ করে দিন ধৈর্য্যের সাথে। ওকে জোর করবেন না। তার বদলে ওই সময় ওর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন। যেমন:
বাড়ীতে কোনো অতিথি হয়ত ওর জন্য খেলনা নিয়ে এসেছে। প্রথমেই যদি সেটি নিয়ে ওর সাথে তিনি খেলতে যান ভুল হবে। বরং নিজে খেলনাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলে নিজে নিজেই বাচ্চার মধ্যে আগ্রহ তৈরী হবে সে বিষয়ে। ও ধীরে ধীরে তার সাথে মেশার চেষ্টা করবে।
২। বাচ্চাকে বিভিন্ন সোশাল গ্যাদারিং র সাথে পরিচিত করান। অন্য কোথাও না নিয়ে গিয়ে বরং বাড়ীতে বন্ধুবান্ধবদের আসতে বলুন। নিজের চেনা পরিবেশে ও অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। তারপর কিছুদিন তাতে অভ্যস্ত হলে নিয়ে যান অন্যান্য বন্ধু বা আত্মীয়দের বাড়ীতে।
৩। কেউ যদি আপনার বাচ্চাকে ওর সামনে ‘শাই’ বলে সেটাকে অ্যাডমিট করবেন না। বরং শান্তভাবে বলুন যে ও একটু সময় নেয় অচেনাদের সাথে কথা বলতে। তাতে আপনার বাচ্চা সহজবোধ করবে।
৪। ইংরিজিতে একটা কথা আছে, ‘মাউথি মাদার মাউসি চাইল্ড’। অনেক মা বা বাবা আছেন, বাচ্চাদের হয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেন। এটা করবেন না। ওকে একটু সময় দিন প্রশ্নের উত্তর গোছানোর জন্য। তারপরেও যদি না পারে তখন ওকে সাহায্য করুন উত্তর দিতে, কিন্তু ওর হয়ে কাজটা করে দেবেন না।
৫। বাচ্চার সাথে বিভিন্ন রকম প্রিটেন্ড গেম খেলুন। এতে ওর ন্যারেটিভ স্কিলের উন্নতি হবে। এই খেলার মাধ্যমে ওকে শেখান কিভাবে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয়। প্রতিটা প্রশ্ন শুনে কিভাবে উত্তর দিতে হয়। এতে ওর মধ্যে কমিউনিকেশন স্কিল উন্নত হবে।
৬। বাচ্চার সাথে ফোনে কথা বলুন। বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনকে বলুন ওর সাথে ফোনে কথা বলতে। এতে ধীরে ধীরে ওর মধ্যে জড়তা কাটবে।
৭। বাচ্চাকে বিভিন্ন ধরণের অ্যাক্টিভিটি সেন্টারে নিয়ে যান। সবার সাথে বিভিন্নধরণের নতুন জিনিস শিখতে ও আগ্রহী হবে।
৮। যদি লক্ষ্য করেন বাচ্চার সোশাল স্কিল একটু একটু বাড়ছে, আর পাঁচটা বাচ্চার সাথে মেশার মতন আত্মবিশ্বাস তৈরী হচ্ছে তখন ওর প্রশংসা করুন। এতে ওর মনে সামাজিক নিয়মকানুন নিয়ে স্বচ্ছ ও পজিটিভ ধারণা তৈরী হবে।
৯। পাবলিক শেমিং বন্ধ করুন:
অনেক মা বাবার ধারণা সবার সামনে বাচ্চাকে বকাবকি করলে, অনযের সাথে তুলনা করলে বা অপদস্ত করলে সে নিজেকে শুধরে নেবে এবং মা বাবা যা নির্দেশ দেবে তাই করবে। কিন্তু এটা একেবারেই ভুল ধারণা। বরং এরকম করলে ওদের মনের মধ্যে এক প্রচন্ড অভিমান বা লজ্জার উদ্রেক হয় যা পরবর্তী ক্ষেত্রে ওদের জেদী ও অবাধ্য মনোভাবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার চেয়ে ওর কাছে সময় চেয়ে নিন, আলাদাভাবে ওর সাথে কথা বলুন। দেখবেন, ও আস্তে আস্তে নিজের মতন করে বিকশিত হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে একটি ছোটো কেস স্টাডির কথা বলি।
সুপর্ণার মেয়ে তানিয়া খুব সুন্দর গান গায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: সেই গানের শ্রোতা কেবল সুপর্ণা আর তার স্বামী। কারণ তানিয়া মা বাবা ছাড়া আর কারোর সামনে পারফর্ম করেনা। কিছুদিন আগে সুপর্ণাদের বাড়ীতে একটা গেটটুগেদার ছিল, সেখানে অনেক বাচ্চাই দিব্যি নাচ গান করল, ব্যতিক্রম শুধু তানিয়া। সুপর্ণা এই নিয়ে ওকে কোনো জোরাজুরি করলনা, বরং আলাদা ঘরে তানিয়াকে ডেকে নিয়ে কাছে টেনে বলল,
‘তোমার যদি ইচ্ছা হয় গান করতে পারো, তুমি গান গাইলে আমার খুব আনন্দ হয়’।
তানিয়া কিছু বললনা। চুপ করে শুনল কেবল। এর বেশ কয়েকমাস পরের কথা। আবার একটি গেটটুগেদারের আয়োজন হয়েছে বাড়ীতে। সুপর্ণা আবার আলাদাভাবে কানে ফিসফিস করে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল সে কোনো গান গাইবে কিনা। তানিয়ার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। মাকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কোন গানটা গাইব বল ‘
সুপর্ণা যদি ওকে ক্রমাগত: পাব্লিক শেমিং র মুখোমুখি দাঁড় করাত ও কোনোদিনই সহজভাবে ব্যাপারটা নিতে পারতনা। কিন্তু এখানে সে তানিয়ার সাথে সবসময় রেসপেক্টফুল কমিউনিকেশন করেছে। তার ফলে তানিয়ার মনের সব অনুভূতি গুলোর সঠিক বিকাশ ঘটেছে। মা কে সে প্রতিদান হিসেবে রেসপেক্টফুল বিহেভিয়ার দেখিয়েছে।
কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘শাইনেস’ বা ‘লজ্জা’ চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে:
আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম তিনটি কেস স্টাডি দিয়ে। এর মধ্যে শেষের ঘটনাটি দোলন বলে ছোট্ট একটি মেয়ের। তাকে আপাতভাবে লাজুক মনে হলেও তাকে ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার সমস্যা অন্য জায়গায়। শাইনেস বা লজ্জা তার সমস্যার একটা বহি:প্রকাশ মাত্র। দোলন আসলে অটিসম স্পেক্ট্রাম ডিসর্ডারের শিকার। তার ফলে সে লোকজনের সাথে কমিউনিকেট করতে পারে না আর সোজাসুজি তাকিয়েও কোনো কথা বলেনা। অর্থাৎ তার আই কনট্যাক্টে সমস্যা।
দোলনের মত অনেকেই এই সমস্যায় ভোগে। মা বাবাদের তাই সচেতন থাকতে হবে বাচ্চার বাকি অ্যাক্টিভিটির ব্যাপারে। সেক্ষেত্রে যদি কোনোরকম ঘাটতি দেখেন তখন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
আপনার বাচ্চাকে দিন আপনার সাহচর্য্য। ধৈর্য্য ধরে মোকাবিলা করুন ওদের সমস্যা। দেখবেন আপনার সঠিক পেরেন্টিং র জাদুতে নিজের মতন করে বড় হয়ে উঠছে আপনার আদরের সন্তান।
(This article has been taken from the book ‘Bhalobashay shaishab’ written by Payel Ghosh and published by ‘Dey’s Publishing’)
Thanq.. ma’am
Pretend game ki mam? Amar meyer age 3.5yrs