সিবলিং রাইভ্যালরি কি? কিভাবেই তা মোকাবিলা করবেন?

 

ছোটবেলায় সুকুমার রায়ের লেখা ‘হিংসুটি’ গল্পটি আমরা অনেকেই পড়েছি। দুই বোনের মধ্যে ছোটটি বড় হিংসা করত বড় দিদিকে। তার সব সময় সবচেয়ে ভালো জিনিসটা নিজের জন্য চাই। তা সে মিষ্টি বা পুতুল যাই হোক না কেন। ভাই বা বোনেদের নিজেদের মধ্যে এই যে প্রতিপক্ষ সম্পর্ক তাকেই বলে সিবলিং রাইভ্যালরি। এ বিষয়ে আমার দেখা দুটি কেস স্টাডির উল্লেখ করি।

মোনালিসা দুই জমজ বাচ্চার মা। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটিকে একা হাতে সবই সামলাতে হয়। তার সাথে সামলাতে হয় জমজ দুই ছেলেকে। দুই ছেলের মধ্যে ঝামেলার শেষ নেই। একজনকে শান্ত করলে আর একজন জেদ শুরু করে আবার তাকে থামালে অনযজন অন্য কিছু বায়না শুরু করে দেয়। মোনালিসা এসব মিলিয়ে এতটাই বিপর্যস্ত যে ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে গেল। সংসার, সন্তান সব কিছু সমন্ধেই তৈরী হল তার প্রবল অনীহা। সব মিলিয়ে সে এখন পুরদস্তুর মানসিক রোগী।

বিশাখার মেয়ে শ্রেষ্ঠার বয়স সাড়ে তিন। মাস দুয়েক আগে বিশাখার আরেকটি মেয়ে হয়েছে। যদিও ওরা শ্রেষ্ঠাকে এ বিষয়ে সব জানিয়েছিল তবুও নতুন সদস্য বাড়ীতে আসার সাথে সাথে শ্রেষ্ঠার আচার আচরণে অনেক পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। কখনও সে একদম চুপচাপ থাকে, কখনওবা ভীষণ জেদী যেগুলো সে আগে কখনই করতনা। কিছুদিন আগেই একটা বড় দুর্ঘটনা হতে চলেছিল ওদের বাড়ীতে। রোজকার মতন ছোট মেয়েটিকে শুইয়ে দুপুরের খাওয়া সারছিল বিশাখা। শ্রেষ্ঠা নিজের মনে খেলছে। হঠাৎ ছোট মেয়েটির কান্নার শব্দে দৌড়ে ঘরে এসে বিশাখা হতভম্ব হয়ে যায়। ও দেখে শ্রেষ্ঠা তার ছোটবোনের মুখে তোয়ালে চেপে তাকে মারার চেষ্টা করেছে আর সে পরিত্রাহী চিৎকার করছে। কোনোক্রমে বিশাখা ওই পরিস্থিতি সামাল দেয়। পরের দিন ও এবং ওর স্বামীব দেখা করে পেরেন্ট এডুকেটরের সাথে। তাতে জানা গেল শ্রেষ্ঠা সিবলিং রাইভ্যালরির শিকার।

 

কেন তৈরী হয় সিবলিং রাইভ্যালরি?

 

সিবলিং রাইভ্যালরি বা ভাই বোনের ইর্ষা আমাদের পরিবারে বা সমাজে কোনো নতুন ঘটনা নয়। যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তনীয়ভাবে তা চলে আসছে। কিন্তু তখন সমাজে যৌথপরিবারের চল ছিল, তাই মানসিক দ্বন্দ্ব বা ইর্ষা এসবগুলো আরো অন্য পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চ্যানেলাইজ করে একটা সমাধানের পথ বেরোত। কিন্তু এখন নিউক্লিয়ার পরিবারে খুদে সদস্যদের মা বাবা ছাড়া কাছে টানার মতন কেউ থাকেনা বাড়ীতে। ফলত: তারা এক অসম্ভব ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে থাকে নতুন কোনো সদস্যের আগমনবার্তা পেলেই।

প্রথম সন্তান একশ শতাংশ ভালবাসা ও অ্যাটেনশন পায় যখন সে একা থাকে। তার সমস্ত চাহিদা, গল্প খেলাধূলোর সঙ্গী তার মা বা বাবা। তাই হঠাৎই যখন নতুন সদস্যের আসার খবর সে পায় স্বাভাবিকভাবেই সে ভয় পেয়ে যায় তার ভালবাসা বা অ্যাটেনশন  শেয়ার করে নেবার জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই ছোট সন্তানটির ওপর সবারই অ্যাটেনশন একটু বেশীই থাকে। তখন থেকেই সূত্রপাত হয় সিবলিং রাইভ্যলরির। ক্রমে বড় বাচ্চাটির মনে হতে থাকে সে বন্চিত হয়ে যাচ্ছে সব কিছু থেকে। তারই আক্রোশ এসে পড়ে ছোট বাচ্চাটির ওপর। অনেক ক্ষেত্রে আবার উল্টো ব্যাপারও হয়। ছোট বাচ্চাটি খুব একটা গুরুত্ব না পেলে তার মনে হয় বড় দাদা বা দিদিকেই মা বাবা বোধহয় বেশী ভালবাসে। ফলে শুরু হয়ে যায় সিবলিং রাইভ্যালরি।

 

এ সমস্যা থেকে কিভাবে সামলাবেন নিজেদের ও বাচ্চাদের?

 

১। সবসময় চেষ্টা করা উচিত দুটি শিশুর মধ্যে যেন তিন থেকে চার বছরের পার্থক্য থাকে। তার বেশীও নয় তার কমও নয়। প্রথম বাচ্চাটি স্বাধীনভাবে কিছু কাজ নিজে করতে শিখে গেলেই দ্বিতীয় বাচ্চার কথা ভাবা উচিত। তা না হলে মা বাবার পরিশ্রম অত্যধিক বেড়ে যায় ও কোনোভাবেই পেরেন্টিং ব্যাপারটা তারা এন্জয় করতে পারেন না। তাদের সেই ক্লান্তি বা হতাশা গিয়ে পড়ে দুটি বাচ্চার ওপর।

২। বাচ্চাকে আগে থাকতে গল্পচ্ছলে জানান বাড়ীর নতুন অতিথির কথা। তার সাথে এটাও জানান সবাই মিলে তার দেখাশোনা করব। সেক্ষেত্রে আপনার বড় বাচ্চাটিকে আগে থেকেই দায়িত্ব দিয়ে রাখুন।

৩। নতুন অতিথি আসার আগে বাড়ীতে একটা ফ্যামিলি মিটিং করুন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিন যাতে নির্দিষ্ট কারোর ওপর চাপ না পড়ে।

৪। বড় বাচ্চাটির প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীল থাকুন। মনে রাখবেন, বাড়ীতে সবচেয়ে অবুঝ মন ওর আর সবচেয়ে বেশী ইনসিকিওরিটিতে ভুগছে ও। কোনোভাবেই ওর যেন এটা মনে না হয় যে মা বাবা আমায় আগের মতন ভালবাসেনা।

৫। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় রাখুন বড় বাচ্চাটির জন্য। ওর সাথে গল্প করুন, ছবি আঁকুন, ওর স্কুলের গল্প শুনতে চান। একসাথে দুজনে বসে মজার কোনো গল্প বই পড়ুন। দেখবেন, প্রতিদিন যদি নিয়ম করে ওর সাথে সময় কাটান ওর মনের মধ্যে রাগ অভিমান জন্মাবার সম্ভাবনাও কমে যাবে। ওকে বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্টিভিটির মধ্যে রাখুন। ওর নিজের একটা জগৎ, বন্ধুবান্ধব সবার মধ্যে থাকলে ওর মধ্যেও আত্মবিশ্বাস তৈরী হবে।

৬। দুই বাচ্চার মধ্যে কোনো তুলনামূলক আলোচনা বা কম্পেয়ার না করাই ভালো। প্রতিটি বাচ্চাই ইউনিক। তাই তাদের দুর্বল জায়গাগুলো কে আলাদাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করুন এবং উৎসাহ দিন।

৭। ওদের সব সমস্যার নিজেরা সমাধান করতে যাবেন না। বরং ওদের ওপর দায়িত্ব দিন নিজেদের সমস্যা মেটানোর জন্য। এর জন্য ওদের মধ্যে রিওয়ার্ড সিস্টেম চালু করতে পারেন। দেখবেন ওরা অনেক সহজভাবে নিজেদের সমস্যা মিটিয়ে ফেলছে।

৮। জেন্ডার প্রায়োরিটি যাতে না হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখুন। আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখা যায় ছেলেদের কদর মেয়েদের থেকে বেশী। বাড়ীতেও অনেক সময় বাচ্চাদের প্রতি অসম আচরন দেখা যায়। অনেকসময় বলতে শুনেছি ‘তুমি মেয়ে, বেশী না পড়লেও চলবে, কিন্তু ভাই তো ছেলে, তাই  অনেক পড়াশোনা করবে ও।’

এর ফলে বাচ্চাদের নির্মল মনে কোথাও যেন একটা তীব্র কষ্ট দানা বাঁধে, যা ধীরে ধীরে সিবলিং রাইভ্যলরির রূপ নেয়।

৯। বাচ্চারা কোনো সমস্যা নিয়ে এলে মন দিয়ে তা শুনুন। অনেকসময় ধৈর্যের অভাবে আমরা পুরো ব্যাপারটা না শুনেই যে একটু দুষ্টু তাকে বকুনি দিই। এটা একদম করবেন না। বরং আলাদাভাবে সমস্যা টা শুনে তার সমাধান করার চেষ্টা করুন।

১০। যাদের জমজ বাচ্চা তারা চেষ্টা করুন দুটি বাচ্চার দুধরনের অ্যাক্টিভিটি প্ল্যান করতে। যেমন একজনকে হোমওয়ার্ক করালে আরেকজনকে ড্রইং র কাজ করান। তার ফলে কেউ কাউকে খুব একটা বিরক্ত করতে পারবেনা।

যাদের দুই বা তার অধিক সন্তান নি:সন্দেহে তাদের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম অন্যদের থেকে বেশী। ফলে বাবা মায়েদের নিজের স্বাস্থ্যের দিকে একান্তভাবে খেয়াল রাখা উচিত। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে নিজেদের জন্য সময় দিন। দেখবেন, চিন্তা বা স্ট্রেস অনেকটাই লাঘব হবে।