বুলিং এবং আপনার বাচ্চা:
দিশার অর্ককে স্কুল থেকে নিতে যাবার সময় রোজই এক প্রচন্ড আতঙ্ক তৈরী হয়। গত একমাস ধরে এমন একদিনও যায়নি অর্কর সমন্ধে কমপ্লেন পায়নি ও। প্রত্যেকদিন অর্ক সমন্ধে নিত্যনতুন অভিযোগ পেতে পেতে ও ক্লান্ত। এই তো সেদিন এক বন্ধুকে এমন মেরেছে যে তার নাক ফেটে গলগল করে রক্ত। মেরে, বকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছেনা তার সাত বছরের ছেলেটাকে।
শিবানীর মেয়ে তিথি বেশ কিছুদিন ধরে স্কুলে যেতে চাইছেনা। অনেকভাবে প্রশ্ন করে শিবানী জানতে পারল তার মেয়েকে উঁচু ক্লাসের মেয়েরা রোজই উত্যক্ত করে। তাকে মারে, টিফি ন কেড়ে নেয়। শান্ত তিথি মুখে কিচ্ছু বলতে না পেরে সহ্য করে ওদের অত্যাচার। কিন্তু মনের মধ্যে এক আতঙ্ক গ্রাস করে এই পরিস্থিতির জন্য। ফলস্বরূপ স্কুলে যাওয়ার প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে ছোট্ট মেয়েটির।
বুলিং কি? কতরকমের বুলিং হতে পারে?
বুলিং হল অসম শক্তির নিম্নগামী আচরন যা কোনো দুর্বল ব্যক্তিত্বকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিতে পারে।
বুলিং সাধারনত: চাররকমের হয়।
১। ভার্বাল বুলিং:
এই ধরনের বুলিংএ বিভিন্ন ধরনের কটু সম্ভাষনে বন্ধুদের ডেকে অপদস্ত করা হয়। এমনকি তার আচারআচরন, অক্ষমতা, ধর্ম বা পরিবারের সদস্য সমন্ধে কটুক্তি এগুলোও বাদ যায় না।
উদাহরন: ছোটু স্কুল থেকে ফিরে প্রায়ই আপসেট থাকে কারণ ওর বন্ধুরা ওকে তোতলা বলে খেপায়। ছোটুর কথা বলতে একটু স্ট্যামারিং সমস্যা হয়।
২। ফিজিকাল বুলিং:
এই ধরনের বুলিং এ শারীরিক ভাবে অত্যাচার করা হয়। বারবার তাকে ঘুষি মেরে বা লাথি মেরে তাকে অপদস্ত করা হয়।
সৌভিক মাঠে খেলতে যেতে ভয় পায় কারন ওর বন্ধুরা ওকে লাথি মারে, ঠেলে ফেলে দেয় কখনও ওর প্যান্ট টেনে খুলে দিয়ে ওকে অপদস্ত করে।
৩। রিলেশানাল বুলিং:
এই ধরনের বুলিংএ মানসিক চাপ দেওয়া হয়। বন্ধুদের গ্রুপে কাউকে পুরো বাদ দিয়ে বাকীদের গল্প করা বা তাকে খেলতে বা গল্প করতে না ডাকা এগুলো রিলেশনাল বুলিং র তালিকাভুক্ত।
শাহীর বন্ধুরা ওর সাথে মাঝে মাঝে খুব খারাপ ব্যবহার করে। অনেক সময়ই ওরা শাহীর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, ওকে খেলতে বা গল্প করতে ডাকেনা। খুব খারাপ লাগে শাহীর। অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে।
৪। সাইবারবুলিং:
সাইবারবুলিং ব্যাপারটি ক্রমাগত বেড়ে চলছে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির সমাজে। বন্ধুদের মধ্যে কারোর সমন্ধে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কটু কিছু লিখে তাকে অপদস্ত করাই হল সাইবারবুলিং।
যে বাচ্চারা বুলিং করছে তাদের সামলাবেন কিভাবে?
১। প্রথমত: মা বাবাকে বুলিং ব্যাপারটি খুব গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। বাড়ীর সব সদস্যরা এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত প্রকাশ না করাই ভাল। বাচ্চা যেন স্পষ্ট বুঝতে পারে বাড়ীর সদস্যরা বন্ধুদের প্রতি তার দুর্ব্যবহার মোটেই মেনে নেননি। ফলত: সে নিজেকে সংযত করতে বাধ্য। এর জন্য মারা বা বকার প্রয়োজন হয়না। নিজেকে শান্ত অথচ দৃঢ় রাখুন। বেশী কথোপকথন করবেন না বাচ্চার সাথে। শুধু শান্ত, কঠোর গলায় কথা বলুন ওর সাথে। তার কিছুক্ষণ পরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে গল্পোচ্ছলে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন।
২। বাচ্চাকে টেলিভিশনে ভায়োলেন্স দেখাবেন না। আজকাল বিভিন্ন কার্টুন প্রোগ্র্যামেও মারপিটের দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। বাচ্চারা ওসব থেকে অনেক কিছু অনুকরন করে এবং স্কুলে দুর্বল বন্ধুদের ওপর প্রয়োগ করে। তাই এই ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রনে থাকা খুবই জরুরি। একই যুক্তি দেওয়া যায় ভিডিও গেম দেখার বা মোবাইলে গেম খেলার ক্ষেত্রেও।
৩। বাড়ীতে দাম্পত্য কলহ যত তীব্র হয় বাচ্চাদের মধ্যে রাগ , ক্ষোভ ততই বাড়ে। তার প্রকাশ ওরা অনেক সময় বাড়ীর বাইরে করে। একটি ছোট ছেলে তার কাউন্সিলারকে বলেছিল, বাড়ীতে বাবা তার মা কে যেভাবে মারে সেভাবেই ও তার বন্ধুকে মেরেছে। তার ফলে বোঝাই যাচ্ছে বাবা মা কে কতটা সংযত থাকতে হবে দৈনন্দিন জীবনে।
৪। বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল স্কিলের ওপর বাচ্চাকে ধারনা দিন। ওকে উপযুক্ত ম্যানারস বা সহবত শেখান। বাচ্চা যদি সবার সামনে সুন্দর আচরন করে ওকে আলাদাভাবে ডেকে প্রশংসা করুন। তাহলে ওর মধ্যে সবার প্রতি ভাল ব্যবহার করার উৎসাহ আরো বাড়বে।
৫। বাচ্চাকে ‘সরি(sorry) কার্ড বানাতে শেখান। যদি ওর বুলিং এ কোনো বন্ধু আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাহলে ও যেন পরের দিন অবশ্যই স্কুলে গিয়ে তাকে সেই কার্ড দেয়। এতে বাচ্চার নিজেরও ঠিক বা ভুল কাজ সমন্ধে ধারনা হয়।
যেসব বাচ্চারা বুলিং র শিকার তাদের সামলাবেন কী করে?
১। বাচ্চার মধ্যে মৌখিকভাবে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বাচ্চাকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া। বাচ্চার সাথে আপনার বন্ডিং খুব ভালো থাকলে তবেই আপনি তার স্কুলজনিত সমস্যার কথা জানতে পারবেন।
২। বাচ্চাকে অ্যাসার্টিভ কমিউনিকেশন শেখান। ও যদি কোন বাচ্চার দ্বারা বুলিড হয় তাহলে এই পদ্ধতি বেশ কাজে লাগে।
এই বিষয়ে একটা উদাহরন দিই।
শর্মিলার মেয়ে প্রজ্ঞা খুব শান্ত ও নরম স্বভাবের মেয়ে। গত কয়েকদিন ধরে ওর পাশে এমন একটি ছেলে বসছে যে ওকে প্রায়ই মারছে। দু একবার ক্লাস টীচারকে সে নালিশও করেছে। কিন্তু উনি বলেছেন ব্যাপারটা নিজেকে সামলাতে। সাত বছরের প্রজ্ঞা তার মা কে এই ব্যপারটি বলায় তার মা একটা উপায় বলে দিলেন। উনি বললেন যখনই কেউ ওকে বুলি করবে ও যেন তার হাত দুটো ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় তার প্রতিবাদ করে। মোটেও যেন কান্নাকাটি না করে। এমন কি তার মা তাকে বাড়ীতে এই বিষয়ে রোল প্লে বা প্র্যাকটিস করিয়ে দিলেন। পরের দিন স্কুলে গিয়ে প্রজ্ঞা পুঙখানুপুঙ্খভাবে তা অনুসরন করল। আশ্চর্যজনক ভাবে তার পর থেকে প্রজ্ঞাকে কখনও বুলিং র শিকার হতে হয় নি।
৩। বাচ্চাকে বলুন মারপিট বা বুলিং এরিয়া থেকে দূরে থাকতে। নিজেদের একটা গ্রুপ বানিয়ে সবাই মিলে একসাথে চলাফেরা করতে।
৪। বাচ্চাদের আউটডোর অ্যাক্টিভিটির দিকে গুরুত্ব দিন। বাইরে বন্ধুবান্ধবদের সাথে যত খেলা করবে ততই ওর মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সরানোর প্রচেষ্টা তৈরী হবে।
৫। মা বাবারা অনেক সময় বাচ্চা বুলিড হয়েছে শুনলে নিজেরা পুরো ব্যাপারটার সাথে জড়িয়ে পড়েন। এটা করবেন না। এর ফলে বাচ্চার আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং বুলিং সমন্ধে ওর আতঙ্ক তৈরী হয়। বরং ওকে নিজেকে রক্ষা করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া বা কৌশল শেখান। ও অনেক বেশী উপকৃত হবে। প্রয়োজনে ওকে না জানিয়ে আলাদাভাবে স্কুল কতৃপক্ষের সাথে কথা বলতে পারেন।
Note: The above text is taken from the Bengali parenting book “Bhalo-bashay shaishab” (published from Dey’s Publishing) written by Parenting Consultant Payel Ghosh.