বাচ্চার সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটান

রমিতা এক ব্যস্ত হোমমেকার। একা হাতে সংসারের পুরো দেখভাল সে করে। তার স্বামী সকাল ন’টার মধ্যে অফিস বেরিয়ে যান আর বাড়ী ফেরেন রাত নটার আগে নয়। ওদের একটি ফুটফুটে চার বছরের মেয়ে আছে, নাম জিয়া। জিয়াকে ঘিরে তার অনেকটা সময় চলে যায়। তার তদারকি করা, খাওয়ানো, চান করানো, প্নে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নাচের ক্লাসে নিয়ে যাওয়া, ঘুম পাড়ানো এসব নিয়ে সারাক্ষণ সে তুমুল ব্যস্ত। কিন্তু রমিতার একটাই দু:খ। সারাদিন মেয়েকে এতটা সময় দিলেও তাকে খুশী করতে পারছেনা সে। দিনে দিনে জিয়া সব কিছুতেই বিরক্তি প্রকাশ করছে। শুধু তাই নয়, ছোটো ছোটো বিষয় নিয়েও সে খুব ঘ্যানঘ্যান করে। কিন্তু বাবা অফিস থেকে বাড়ী ফিরলে জিয়া অন্য মেয়ে। বাবা গলা জড়িয়ে গল্প করা, খিলখিলে হাসিতে বাড়ী মাতোয়ারা করে তোলা সবই হতে থাকে সেই সময়ে। অনেক সময় অনেক রাত করে বাড়ী ফিরলেও জিয়া না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করে তার বাবার জন্য। এগুলো দেখে এক মনখারাপ ও বিষাদ ভর করে তোলে রমিতা কে। তাহলে মায়ের কোনো জায়গাই নেই জিয়ার জীবনে?

বিভার ঘটনাটি আবার অন্যরকম। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করা বিভার বাড়ী ফিরতে প্রায়ই বেশ রাত হয়। তার স্বামী মেরিন ইন্জিনিয়ার। বছরের অনেকটা সময় তাকে বাড়ীর বাইরে কাটাতে হয়। বিভা তার মা ,বাবা ও ছেলেকে নিয়ে থাকে। কখনো কখনো বিভাকে দেশ বিদেশে ট্যুরেও ছুটতে হয়। দিনের অনেকটা সময় তার পাঁচ বছরের ছেলে আরুশ তার দাদু দিদা ও আয়ার সাথে থাকে। বেশ কিছুদিন ধরেই বিভার মনে হচ্ছে আরুশের সাথে তার একটা দুরত্ব তৈরী হচ্ছে। কাছে আসা তো দূরের কথা, রীতিমত বিরক্ত হয় সে মায়ের সান্নিধ্যে। এক অসম্ভব মনখারাপ বিভাকে কুরে কুরে খায়। কাজে মন বসাতে পারেনা সে।

উপরোক্ত দুটি ঘটনাই আমরা অনেক সময়ে অনেকের ক্ষেত্রে দেখে থাকি। অভিভাবক হিসেবে বাচ্চাকে সময় দেবার দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে আমাদের ওপর বর্তায়। কিন্তু অনেক সময়েই আমরা ঠাহর করতে পারিনা কিভাবে সেই সময়টা দেওয়া উচিত।

সাধারনত: দেখা যায় দুভাবে বাচ্চাকে আমরা সময় দিই। কোয়ান্টিটি সময় আর কোয়ালিটি সময়। আমরা শুরু করেছিলাম রমিতার কেস স্টাডি দিয়ে। রমিতা সারাক্ষণ বাচ্চার পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। তাকে চান খাওয়া করানো, ঘুম পাড়ানো এসব কাজে তার সময় চলে যায়। কিন্তু বাচ্চার সাথে বসে গল্প করা, খেলাধূলো করা, তার সাথে বসে একসাথে খাওয়া, বই পড়ে শোনানো, কোনোটাই সে করে উঠতে পারেনা। ফলত: বাচ্চা সারাদিন মা থাকা সত্বেও একাকিত্বে ভোগে। রমিতা বাচ্চাকে কোয়ালিটি নয় কোয়ান্টিটি সময় দেয়। কিন্তু অপরদিকে রমিতার স্বামী খুব কম সময় বাচ্চার সাথে সময় কাটালেও যেটুকু সময় উনি দেন তা নিখাদ কোয়ালিটি টাইম। তার ফলে সারাটাদিন অপেক্ষা করে থাকে বাচ্চা ওই সময়টুকুর জন্য। বাবার সান্নিধ্য সে খুবই পছন্দ করে।

বিভার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তার বাচ্চা প্রাথমিকভাবে নি:সন্দেহে তার কাছে সময় চেয়েছিল। কিন্তু একটা প্রপার প্ল্যানিং র অভাবে বিভা সেই সময়টা দিতে পারেনি তার বাচ্চাকে। ফলত: তার বাচ্চা তার প্রাপ্য আনন্দটুকু পেতে আঁকড়ে ধরেছে তার দাদু দিদাকে। বিভার উপস্থিতি তার কাছে কোনো বিশেষ প্রভাব ফেলেনা। উপরন্তু সে বিভাকে অবজ্ঞা করা শুরু করেছে তার জমে থাকা ক্ষোভ থেকে। বিভা যদি বাচ্চাকে সময় দেবার বিভিন্ন উপায় না ভাবে, ক্রমশ: দূরত্ব সৃষ্টি হবে মা আর সন্তানের। একটা সময়ে বিভা তাকে কাছে পেতে চাইলেও তার সন্তান তার কাছে আসার তাগিদ অনুভব করবেনা।

কিভাবে সময় কাটাবেন বাচ্চার সাথে:

বাচ্চার সাথে সময় কাটানোর জন্য সারাদিন কাছ ঘেঁষে থাকার প্রয়োজন হয়না। যদি দিনে একঘন্টাও কাটান তাও চলবে স্বচ্ছন্দে। কিন্তু সেই সময়টা হতে হবে নিরবিচ্ছিন্ন। তাতে মোবাইল, ল্যাপটপ আর টি.ভি র প্রবেশ নিষেধ।
১। ওদের সাথে খেলা করুন। দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় রাখুন যেখানে বিভিন্ন রকম খেলা খেলুন ওদের সাথে। তা সে ইন্ডোর বা আউটডোর যেকোনো রকম খেলাই হতে পারে। ওদের সাথে বসে পাজল করুন, বিল্ডিং ব্লক দিয়ে বাড়ী বানান, পুরোনো কাপড় দিয়ে পুতুলের জামা কাপড় ডিজাইন করুন, ফুটবল ক্রিকেট খেলুন। দেখবেন, কত রকম অজানা তথ্য জানবেন আপনার বাচ্চার সম্পর্কে। ওর সাথে আপনার বন্ডিংটাও ক্রমশ: শক্তপোক্ত হবে।

২। একসাথে বই পড়ুন। এটা আরেকটা দারুন উপায় বাচ্চার সাথে কোয়ালিটি সময় কাটানোর। বাচ্চার সাথে বই পড়লে ওর মনে ইমোশনাল সিকিউরিটি তৈরী হয় যা বাচ্চার পজিটিভ চিন্তাশক্তির সহায়ক। ঘুমের আগে এটা করলে খুব ভালো হয়। বাচ্চা শুধু যে বইকে ভালোবাসতে শুরু করবে তা নয়, ওর মধ্যে পড়ার অভ্যাসও তৈরী হবে যা ওর ভবিষ্যতে সুঅভ্যাস গড়ে তুলবে। অনেকসময় মুখরোচক স্ন্যাকস সহযোগেও বই পড়তে পারেন। এতে বাচ্চা খুব আকর্ষিত হবে।
৩। একসাথে বসে ড্রইং বা ক্র্যাফ্টের কাজ করুন। বাচ্চা অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাবে আপনার কাছ থেকে।
৪। একসাথে বিভিন্ন সহজ রেসিপি রান্না করতে পারেন। একসাথে ঝালমুড়ি বানালেন, কেক বানালেন। এসবের মধ্যে বাচ্চা যে শুধু আপনার সান্নিধ্য পাবে তা নয়, ওর মধ্যে অনেক ধরনের ক্রিয়েটিভ চিন্তাভাবনা আত্মপ্রকাশ করবে। বাচ্চার মধ্যে পারিপার্শিক সমন্ধে জ্ঞানও বাড়বে।
৫। একসাথে গাছের পরিচর্যা করুন। এখনকার ফ্ল্যাটবাড়ীতে বাগান করা স্বপ্নসম। কিন্তু ছোটো ছোটো টবে গাছ রাখতে পারেন। বাচ্চা ও আপনি দুজনে মিলে তার যত্নআত্তি করুন। গাছপালা সম্পর্কে ওর মনে একটা পজিটিভ চিন্তাভাবনা তৈরী হবে।
৬। মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ দিন ওকে। আমরা বেশীরভাগ সময়ে বাচ্চাদের উপহার দেওয়া বলতে বুঝি চিপস, চকোলেট, খেলনাপাতি। কিন্তু ওদের কাছে তার থেকে ঢের প্রিয় হল আপনার সাথে সময় কাটানো। স্কুলে মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ ভিজিট দিন। ওকে স্কুল থেকে পিক আপ করে বেরিয়ে পড়ুন কোথাও বেড়াতে। সামনা সামনি পার্ক হলেও চলবে। দেখবেন ওর স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করবে আপনার সাথে কাটানো সময়।
৭। বাড়ীতে প্রিটেন্ড গেম খেলুন বাচ্চাদের সাথে। কখনও আপনি হোন স্টুডেন্ট, ও হোক ম্যাডাম, কখনও বা আপনি পেশেন্ট ও ডাক্তার। এসব খেলাতে মজাও আছে, বাচ্চার কমিউনিকেশন ও ভালো হবে।
৮। বাড়ীতে বাচ্চার বন্ধুদের ডেকে গল্পের আসর বসান। সেই ছোটোবেলার দিনগুলোতে ফিরে যান। দেখবেন, আপনি নিজেও আপনার শৈশব এভাবেই কাটিয়েছেন। একা একা কার্টুন দেখার থেকে বা গেমস খেলার থেকে ঢের মজার সবার সাথে বসে গল্প শোনা।
৯। দিনের শেষে বাচ্চার সাথে হাত ধরে হাঁটতে বেরোন। বিদেশে অনেকে এটাকে বলেন ‘পাজামা ওয়াক’। দেখবেন আপনার হাতের স্পর্শে ওর মনের মধ্যে জমে থাকা দু:খ, আনন্দ সব কিছু কত সহজে শেয়ার করবে আপনাকে একান্তে পেয়ে।
১০। ‘এখন নয় পরে শুনবো’ এটা বলবেন না। এতে বাচ্চার মনে অভিমান জন্মায়। হয়ত আপনি দরকারি কোনো কাজ করছেন, আপনার বাচ্চা খুব উৎসাহ নিয়ে কিছু বলতে এল, আপনি হয়ত শোনার কোনো উৎসাহ দেখালেন না। এটা বাচ্চার নরম মনকে আঘাত দেয়। হয়ত ভবিষ্যতে ও আর কোনো কথা বলতে চাইবেনা আপনাকে। থাক্ না দরকারি কাজ একটু বাকী। কাজ একটু থামিয়ে যদি ওর কথা শোনেনই খুব ক্ষতি হবে কি? একবার যদি শোনেন, ওর সেই ভীষণ ভাললাগার মুহূর্তটাই মনে চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।

বাচ্চার সাথে সময় কাটানো আজকালকার দিনে খুবই প্রয়োজনীয়। আগে বেশীরভাগ পরিবারই ছিল যৌথ। তাই ভাই বোনের সান্নিধ্যে শৈশব কাটত দারুন মজায়। কিন্তু এখন প্রায় সব পরিবারই নিউক্লিয়ার। তার ফলে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর লোকজনের বড় অভাব। কিন্তু তাদের শৈশবের আনন্দগুলোকে তো উপেক্ষা করা যায় না। তাই মা বাবা হিসেবে তাদের কোয়ালিটি সময় দেওয়া একান্ত জরুরি। এটা যারা পালন করবেন তাদের বাচ্চারা নি:সন্দেহে সুস্থ স্বাভাবিক শৈশব পাবে।