বাচ্চার মধ্যে কিভাবে আত্মবিশ্বাস বা সেল্ফ রিলায়েন্স গড়ে তুলবেন?

ছ বছরের রৌণক পড়াশোনায় খুবই ভাল। সকাল সন্ধ্যে তার মায়ের কাছে নিয়মিত পড়াশোনা করতে বসে। কিন্তু পরীক্ষার দিন এগিয়ে এলেই সে ক্রমশ: গুটিয়ে যায়। তার কেবল মনে হতে থাকে সে বোধহয় কিচ্ছু লিখতে পারবেনা। অনেকসময় এসব চিন্তা করতে করতে তার জ্বর ও এসে যায়।
আট বছরের কৌশিকী এখনো তার মায়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। তার চান, খাওয়া, পড়াশোনা সবই মা ছাড়া হবার জো নেই। এদিকে স্কুলে প্রতিদিনই প্রচুর কমপ্লেন আসছে কৌশিকীর অগোছালো স্বভাবের জন্য। এমনকি হোমওয়ার্ক খাতাও সঠিকভাবে জমা দিতে পারেনা মেয়েটি।
তানিয়া প্রথমদিকে স্কুলে যেতে চাইলেও এখন স্কুলে যাওয়া নিয়ে প্রায় রোজই খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়। অনেকসময় ক্লাসে বসে টয়লেট করে ফেলে পাঁচবছরের তানিয়া। সেই নিয়ে বন্ধুবান্ধবেরা হাসাহাসি করেছে, এমনকি ক্লাসটিচার ও একটু বকাবকি করেছেন। তার ফলে স্কুলে যাওয়া রীতিমতো আতঙ্কের মতন হয়ে গেছে তানিয়ার কাছে।
রৌনক ,কৌশিকীর তানিয়ার মতন অনেকে আছে যাদের নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস একেবারেই কম। তার ফলে স্কুল বা বাড়ীর বাইরে বন্ধুবান্ধব বা শিক্ষক শিক্ষিকার কাছে অনেকসময়ই তারা উপহাসের পাত্র হয়ে ওঠে। ক্রমশ: তারা নিজেদের সমাজের কাছে অযোগ্য ভাবতে শুরু করে। আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেয় নিজেদের। এসবের প্রভাব তাদের পড়াশোনার ওপরও পড়ে। অনেকসময় তারা অল্পেতেই ভেঙে পড়ে।

আত্মবিশ্বাস বা সেল্ফ রিলায়েন্স আসলে কি?
একজন মানুষ যখন স্বাধীনভাবে চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সুষ্ঠভাবে নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারে তাকে আত্মবিশ্বাসী বা সেল্ফ রিলায়েন্ট বলা হয়। একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে চালিত করতে পারে তা যত বিপর্যয় আসুক না কেন।
খুব ছোট বয়স থেকেই মা বাবাদের উচিত বাচ্চাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা। কিন্তু তার জন্য বাচ্চাদের প্রোটেকটিভ পেরেন্টিং র মধ্যে রাখলে হবে না। আস্তে আস্তে তাদের চিন্তা ভাবনাকে বিকশিত করার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে তারা মা বার ওপর ক্রমান্বয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

কিভাবে আপনার বাচ্চার মধ্যে আত্মবিশ্বাস যোগাবেন?

১। বাচ্চার তিনবছর বয়স হলেই ওকে আস্তে আস্তে বিভিন্ন রকম রোজকার কাজ করতে শেখান। শুরু করুন চুল আঁচড়ানো দিয়ে। ওর পছন্দমত রঙের চিরুনি কিনে আনুন। ওকে খুব ভাল করে নিজে দেখিয়ে দিন কিভাবে কাজটা করতে হবে। তারপর ওকে উৎসাহ দিন নিজে কাজটা করার জন্য। প্রথমদিন নিশ্চয় আপনার মতন সুন্দর করে কাজ করতে পারবেনা। কিন্তু তার জন্য কখনই ধৈর্য্য হারাবেন না বা বকাবকি করবেন না। তা হলে ওর নিজের কাজ করার ইচ্ছেটাই চলে যাবে। কিছুদিন ওকে সময় দিন কাজটা শেখার জন্য। একদিন দেখবেন ও নিজেই সুনিপুণভাবে কাজটা শিখে ফেলেছে। ওকে সেদিন যেন পুরষ্কৃত করতে ভুলবেননা। এভাবেই ক্রমান্বয়ে ওকে নিজে নিজে দাঁত মাজা, হাতমুখ ধোয়া, টয়লেট করতে যাওয়া,খাওয়া, জুতোর ফিতে বাঁধা প্রভৃতি শেখাবেন। দেখবেন, এক দুবছরের মধ্যেই ও যথেষ্ট আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
২। আপনার সন্তানকে ভরসা করুন। এতে ওর মধ্যে সহজেই আত্মবিশ্বাস তৈরী হবে। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি সহজ হবে।
সুরমার মেয়ে তার কাছে বায়না করল জলভর্তি গ্লাস কিচেন থেকে খাবার টেবিলে নিয়ে যাবে। এই আবদার শুনে সুরমা প্রায় আতঙ্কিত হয়ে ওকে নিরস্ত করতে গেল। পরিণতিতে ছোট্ট মেয়েটি ঘাবড়ে গিয়ে গ্লাসটি হাত থেকে ফেলে দিল।
অপরদিকে রুবানের মা একটু অন্যরকমভাবে ব্যাপারটা দেখলেন। রুবান গ্লাসভর্তি জল নিয়ে যাবার আবদার করতেই তিনি সাগ্রহে রাজী হয়ে গেলেন। তার সাথে এটাও বললেন ‘আমি জানি তুমি কাজটা পারবেই, কিন্তু না পারলেও কোনো সমস্যা নেই’। রুবান দ্বিগুন উৎসাহে ভয়হীন ভাবে কাজটা করে ফেলল। সাথে পেল অনেক প্রশংসা সবার কাছ থেকে।
৩। বাচ্চাকে বিভিন্ন রকম গ্রুপ অ্যাকটিভিটি করতে উৎসাহ দিন। এতে ওর যে শুধু একাকিত্ব ঘুচবে তা নয়। বরং ওর মধ্যে সংগঠনমূলক কাজ করার প্রবণতা বাড়বে। নিজস্ব চিন্তাশক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাও বাড়বে। ছোটোবেলায় আমরা দল বেঁধে যেসব খেলা খেলতাম(চোর পুলিশ, দাগবাসন্তী) তাতে খেলার সাথে সাথে আমাদের চারিত্রিক গঠনও প্রভাবিত হত। এখনকার বাচ্চাদের দল বেঁধে খেলার অভ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে। ফ্ল্যাটবাড়ীর গন্ডিবদ্ধ জীবনে বাবা মা আর গুটিকয়েক কার্টুন ক্যারেকটারদের নিয়ে কাটে তাদের শৈশব। তারফলে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিক্ কীভাবে সামলাতে হয় সেই সম্যক ধারণাটুকু তাদের তৈরী হয়না।
৪। বাচ্চাকে লিমিটেড চয়েসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। একটা উদাহরন দেওয়া যাক। নিধি তার বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে যাবে। পাঁচ বছরের নিধি খুবই আহ্লাদিত বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্মদিনে যাবে বলে। নিধির মা ওকে তিনটে অপশন দিল— বই , খেলনা, আঁকার সরন্জাম। তিনি নিধিকে বললেন এর মধ্যে যে কোনো একটি উপহার বন্ধুর জন্য সে নিয়ে যেতে পারে। নিধি খুব খুশী বন্ধুর জন্য নিজে গিফ্ট পছন্দ করবে। এতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ার সাথে সাথে একটা ধারণা তৈরী হল জন্মদিনে কি ধরণের উপহার দেওয়া হয়। আপনার বাচ্চাকে বিভিন্ন রকম জায়গায় এই লিমিটেড চয়েসের অপশন দিয়ে দেখুন। ওর মনোবল অনেক বাড়বে।
৫। বাচ্চাকে ছোটোখাটো ঘরোয়া কাজের দায়িত্ব দিন। এতে ওর নিজেকে পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মনে হবে। তার ফলে ওর মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরী হবে।
৬। বাচ্চাকে অন্যদের সাথে তুলনা করতে যাবেন না। এটা পেরেন্টিং র সবচেয়ে বড় ভুল পদক্ষেপ। এতে বাচ্চা শুধু যে কষ্ট বা আঘাত পায় তা নয় বরং নিজের কর্মক্ষমতা সমন্ধে নিজেই দ্বিধায় থাকে। এছাড়া ওকে সবার সামনে বকাবকি করলে বা ‘বোকা’, ‘গাধা’ এসব আখ্যা দিলে ওর পক্ষে আত্মবিশ্বাসী হবার সম্ভাবনা কমে যাবে।
৭। বাচ্চারা মা বাবার প্রতিটা আচরণ অনুকরণ করে। তাই নিজের ইমেজকে সবসময় পজিটিভ রাখুন। কোনোভাবেই বাচ্চার সামনে নিজেরা ভেঙে পড়বেন না। এটা বাচ্চার মনে চরম দুর্বলতা তৈরী করে। বরং বাচ্চারা আপনাকে শান্ত, সংযমী সহিষ্ণু দেখে বড় হোক। দেখবেন ওর মধ্যে এমনিতেই আত্মবিশ্বাস তৈরী হবে।
৮। বাচ্চার বন্ধুবান্ধবদের মনিটর করুন। অনেক সময় দেখা যায় বাড়ীর আবহাওয়া পজিটিভ থাকলেও স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের প্রভাবে আপনার বাচ্চা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছে। ওর সাথে কথা বলুন। গল্পচ্ছলে জানতে চান স্কুলের বন্ধুদের গল্প। ও কোনো সমস্যায় পড়লে সেটা মোকাবিলার পরামর্শও দিন। দেখবেন, ধীরে ধীরে ও শিখবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে। এ প্রসঙ্গে ওর সাথে প্রিটেন্ড গেম ও খেলতে পারেন।
৯। অনেক মা বাবা মনে করেন বাচ্চাকে বিভিন্ন ধরণের অ্যাকটিভিটি ক্লাসে ভর্তি করলেই দায়িত্ব সারা হয়ে গেল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সপ্তাহে প্রায় সাত দিনই বাচ্চার আঁকাঝোঁকা, নাচ, গান ,সাঁতার কবিতা শেখা এসব রুটিন রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাচ্চারা সব অ্যাকিটিভিটি নিজের ইচ্ছায় করেনা, চাপিয়ে দেওয়া হয়। এতে বাচ্চার জীবন বড্ড যান্ত্রিক হয়ে যায়। বর্তমানে কিছু সমীক্ষা থেকে জানা গেছে বাচ্চাদের প্রতিদিনই কিছুটা সময় ফ্রি আনস্ট্রাকচারড সময় দেওয়া দরকার। সেটা তাদের মনে শুধু যে অনাবিল আনন্দ দেবে তা নয়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাচ্চারা নিজেরা মাথা খাটিয়ে অনেক নতুন ধরণের খেলা তৈরী করছে। নিজেদের কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রকম জিনিস বানাচ্ছে। এভাবেই মনের গভীর স্তরে ওরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে।
১০। বাচ্চার শারীরিক গঠনের ওপর জোর দিন। ওকে নিয়মিত এক্সারসাইজ করান। শরীর সুস্থ থাকলে ওর মনের জোর ও বাড়বে। সবার সাথে খেলাধূলো করার ইচ্ছাও তৈরী হবে।

মনে রাখবেন আপনার সাহচর্য্যই আপনার শিশুকে মানসিকভাবে অনেকটা এগিয়ে দিতে পারে। বকাঝকার বদলে উপযুক্ত পেরেন্টিং পদ্ধতি ওর ভবিষ্যৎকে আত্মপ্রত্যয়ে বলশালী করে তুলতে পারে।

Note: The above text is taken from the Bengali parenting book “Bhalo-bashay shaishab” (published from Dey’s Publishing) written by Parenting Consultant Payel Ghosh.