কিভাবে আপনার বাচ্চাকে স্কুলের পড়াশোনার সাথে অভ্যস্ত করে তুলবেন?

জয়িতার দিনরাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ওর পাঁচ বছরের মেয়ে সুহানা। প্রত্যেকদিন ক্লাসটিচারের কাছ থেকে সুহানার নামে কমপ্লেন বাঁধা। সুহানা একদিনও তার ক্লাসওয়ার্ক শেষ করেনা। শুধু তাই নয়, বাকী স্টুডেন্টদের অসম্ভব বিরক্ত করে।

জয়িতা নিজে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কাজ করে। স্বামী জয়দীপকেও অফিসের কাজে প্রচুর ট্যুর করতে হয়। সারাদিন অফিস করে আসার পর ডায়েরী তে গাদাখানেক কমপ্লেন দেখে প্রতিদিনই ভীষণ মনমরা হয়ে যায় জয়িতা। ক্লান্ত শরীরে সুহানার বাকী বন্ধুর মায়েদের কাছ থেকে হোমওয়ার্ক জানাটা তার অবশ্যকর্তব্য তালিকার মধ্যে পড়ে এখন। মাঝে মাঝে ভীষণ লজ্জা করে ওর এভাবে পড়াশোনা করাতে। মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে জয়িতা মেয়েকে মারধোর ও করে ফেলে। কখনো ভাবে চাকরিটাই ছেড়ে দেবে। সব মিলিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে সে।

জয়িতার মতন সমস্যায় অনেক বাবা মা রাই পড়েন মাঝে মাঝে। বাচ্চাদের মধ্যে ক্লাস ইন্স্ট্রাকশন ফলো না করার অনেক কারণ থাকতে পারে।

  • প্রথমত: বড় স্কুলের নিয়মকানুন সমন্ধে অনেক বাচ্চাই প্রথমদিকে ঠিকমতন ওয়াকিবহল হয় না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্লে স্কুলের পরিবেশ থেকে আসে। তাদের কাছে পড়াশোনা করার পদ্ধতিটাই সুস্পষ্ট হয় না।
  • অনেক বাচ্চা ADHD(Attention deficit & hyperactivity disorder) র সমস্যায় ভোগে।
  • অনেক বাচ্চার ক্লাসরুমের নিয়মকানুন মোটেই পছন্দ হয়না। ফলে নিয়মবাঁধা ক্লাসের তীব্র প্রতিবাদ জানায় ক্লাস ইন্স্ট্রাকশন ফলো না করে।

কিভাবে আপনার বাচ্চাকে স্কুলেরপড়াশোনার সাথে অভ্যস্ত করে তুলবেন?

  • বাচ্চা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তখনই দেখাবে যখন আপনি ওর সাথে কানেক্টেড থাকবেন। প্রতি সন্ধ্যেবেলায় নিয়ম করে বাচ্চার সাথে বসুন। স্কুলের বিভিন্ন ঘটনা ওর কাছ থেকে শোনার চেষ্টা করুন। কোন ক্লাসে কি কি শেখানো হলো, তা উৎসাহভরে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করুন। এই সময় বাড়ীতে টি.ভি, মোবাইল এগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। কারণ তাতে মন বিক্ষিপ্ত হতে পারে।
  • স্কুল ডায়েরী খুঁটিয়ে ফলো করুন। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রতিযোগীতা, বা সম্ভাব্য পরীক্ষাসূচি এগুলো সমন্ধে স্বচ্ছ ধারনা রাখার চেষ্টা করুন প্রথম থেকেই। ক্লাসটিচারের সাথে যোগাযোগ রেখে জানতে পারেন কি পদ্ধতিতে ক্লাস ফলো করানো হচ্ছে।
  • হোমওয়ার্ক করানোর সময় নিজে সুস্থির হয়ে বসুন। অশান্ত মনে কখনই বাচ্চাকে পড়াতে বসবেন না। যদি আপনি ক্লান্ত থাকেন তাহলে পর্যাপ্ত পরিমানে বিশ্রাম নিয়ে পড়াতে বসুন বা বাড়ীর অন্য কোন সদস্যকে বলুন ওকে সাহায্য করতে। সবসময় মনে রাখবেন, আপনি নিজে যদি মানসিক শান্তিতে না থাকেন তাহলে পড়ানোর সময় তার প্রভাব আপনার বাচ্চার ওপর পড়বে। তাই আপনার শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটা খুবই জরুরি। হোমওয়ার্ক করানোর সময় ওকে নিশ্চয় সাহায্য করুন বা বার বার বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিন, কিন্তু কখনোই ওর হয়ে হোমওয়ার্ক করে দেবেন না। একবার এ অভ্যাস হয়ে গেলে কখনই ও আর নিজে কাজটা করতে চাইবেনা। এটাই বরং ওকে নিজেকে বুঝতে দিন কিভাবে যত্ন নিয়ে কাজ করতে হয়। হয়ত প্রথম প্রথম ভুলভ্রান্তি হবে, ক্লাসে খুব ভালো গ্রেড নাও হতে পারে। কিন্তু দেখবেন আস্তে আস্তে ও নিজেই সুন্দরভাবে নিজের কাজ করতে পারছে।
  • বাচ্চার ডায়েটচার্টের খেয়াল রাখুন। পুষ্টিকর ব্রেকফাস্ট বাচ্চাকে সারাদিন তরতাজা রাখতে পারে। তাই স্কুল যাবার আগে চেষ্টা করুন হোল গ্রেন জাতীয় কিছু ব্রেকফাস্টের তালিকায় রাখতে। তার সাথে তাজা ফল এবং প্রোটিন জাতীয় কিছু খাবার থাকাও দরকার। এই ধরণের খাবার বাচ্চার মনসংযোগ ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। যতটা পারবেন খাবারে চিনি মেশানোর পরিমান কম রাখাই ভালো। যে সব বাচ্চারা অতিচঞ্চল( hyperactive) তাদের খাবারে অতিরিক্ত চিনি না থাকাই শ্রেয়।
  • বাচ্চাদের একান্ত প্রয়োজন পর্যাপ্ত ঘুম। প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাদের রাত্রে কমপক্ষে আট ন ঘন্টা নিশ্চিন্ত ঘুমের প্রয়োজন। তাই ঘুমনোর একটি নির্দিষ্ট সময় থাকা দরকার।বাচ্চারা প্রয়েজনমাফিক না ঘুমোলে স্কুলে গিয়ে ক্লান্ত বোধ করে। ফলে পড়াশোনায় মনসংযোগ করতে পারেনা। ঘুমোতে যাবার আগে টি.ভি দেখা, মোবাইল বা ভিডিও গেম খেলা একেবারেই উচিত নয়। এর ফলে নার্ভাস সিস্টেম উত্তেজিত হয়ে যায় আর ঘুম আসতে চায়না। বরং ঘুমের আগে বাচ্চাদের মধ্যে রিডিং হ্যাবিট গড়ে তুলুন।
  • বাচ্চাকে ধীরে ধীরে অর্গ্যানাইজিং স্কিল শেখান। বিভিন্ন কাজের জন্য সময় নির্ধারন করে দেওয়া বা নিজের রুটিন নিজে গুছিয়ে ব্যাগের মধ্যে নেওয়া, নিজেই নিজের পেন্সিল শার্প করা, এসব কাজগুলো খুব ছোট বয়স থেকেই শুরু করা উচিত। তাহলেই বাচ্চার মধ্যে নিজের কাজ সম্পর্কে দায়িত্ববোধের জন্ম নেবে।

এ প্রসঙ্গে একটি কেস স্টাডির উল্লেখ করছি।

শিনা ছোট থেকেই খুব আদরে মানুষ। তার স্কুলভিত্তিক সমস্ত কাজই তার মা বাবা সযত্নে করে দেন। স্কুল কামাই করলেও তার মা বন্ধুদের কাছ থেকে সমস্ত হোমওয়ার্ক জেনে ওকে তৈরী করাতেন। কিন্তু শিনা যতই উঁচু ক্লাসে উঠতে থাকছে ততই ওর মধ্যে দায়িত্বজ্ঞান কমতে থাকছে। উল্টে মা বাবার কাছ থেকে ওর চাহিদার পরিমানও ক্রমাগত বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই মা বাবা খুবই চিন্তিত শিনার এই ব্যবহারে।

শিনার অভিভাবকের মতন অনেকেই আছেন যারা বাচ্চাদের স্কুল সংক্রান্ত নিজস্ব করণীয় কাজটা নিজেরা করে দেন। এতে বাচ্চার মধ্যে কাজ করার ইচ্ছেটাই চলে যাবে। ক্রমশ: ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে থাকবে তারা।

  • অনেকসময় বাড়ীর পরিবেশে বাচ্চা পড়তে আগ্রহী হয়না। লেখার অভ্যাসও করতে চায়না। তাই বাড়িতে পড়াশোনাকে একটু অ্যাক্টিভিটির মধ্যে করালে খুব ভালো হয়। যেমন যে বাচ্চাটির মধ্যে লেখার অনীহা আছে, তাকে যদি বাড়ীতে ব্ল্যাকবোর্ডের মাধ্যমে লেখানো যায়, সেটা তাকে উৎসাহ দিতে পারে। অনেক সময় পেন্সিলে বাচ্চারা লিখতে পছন্দ করে না। তাই মাঝে মাঝে বাড়ীতে কালার পেন্সিল দিয়েও লেখাতে পারেন। ওরা আনন্দ পাবে।
  • স্কুলে বাচ্চার অ্যাটেনডেন্সের হার সমন্ধে সচেতন থাকুন। আলস্যজনিত কারণে স্কুলে না যাওয়া বা বেড়ানোর জন্য স্কুল কামাই করা, এই ধরণের অভ্যাস গুলোকে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভালো। স্কুলে রোজ যাওয়াটা প্রয়োজনীয়, এই বিষয়ে একটা স্বচ্ছ ধারনা অভিভাবক এবং বাচ্চা দুপক্ষেরই থাকা দরকার।
  • অবসর সময়ে বাচ্চার সাথে স্কুলসংক্রান্ত গল্প করুন। কি কি বিষয় ওর পড়তে ভালো লাগছে বা কিভাবে ক্লাসে পড়ানো হচ্ছে বা স্কুলের নিয়ম কানুন, এসব নিয়ে প্রাথমিক ক্লাসে যত বেশী আলোচনা করবেন তত আপনিও ওকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আপনার সন্তানের সাথে আপনার সম্পর্কও আরো দৃঢ় হবে।

Note: The above text is taken from the Bengali book “ইশকুলের মুশকিল আসান” (published from Dey’s Publishing) written by Parenting Consultant Payel Ghosh.