আপনার সন্তানের সাথে আপনার সম্পর্কের ভিত কেমন করে মজবুত করবেন?

নন্দিতা তার একমাত্র সন্তান রিয়ার জন্য প্রাণপাত করে দেয়। স্কুলের টিফিন থেকে পড়াশোনা করানো, কোথাও এতটুকু ত্রুটি নেই তার। কিন্তু তবুও সবসময় মেয়ের সাথে সমস্যা লেগেই আছে তার। তার সবসময় মনে হয় তার সন্তানের সাথে কোথাও যেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার।
সন্তানের সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরী করার ইচ্ছে প্রতিটি অভিভাবকেরই থাকে। কিন্তু অনেকসময়ই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনা আমাদের অনেকধরণের পেরেন্টিং সমস্যার জন্য। তাহলে উপায় কি?

১। স্পর্শ: সন্তান ছোট হোক বা বড়, মা বাবার স্পর্শ খুবই জরুরি তাদের কাছে। বিভিন্ন রিসার্চের থেকে জানা গেছে প্রাপ্তবয়স্কদের সুন্দরভাবে জীবনধারণের জন্য অন্তত:পক্ষে দিনে চারবার তার প্রিয়মানুষদের কাছ থেকে স্পর্শের প্রয়োজন আছে। সেক্ষেত্রে ছোটদের জন্য তার প্রয়োজন দিনে বারোবার। সবসময় যে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে হবে এমনটি কিন্তু নয়। কখনো চুলে বিলি কেটে দিলেন, কখনও বা পড়াশোনা করার সময় ঘাড়ে একটু মাসাজ করে দিলেন, কখনো বা শুধুই হাসলেন বা চোখের ইশারায় কথা বললেন। দেখবেন, আপনার সন্তান কত সহজভাবে আপনার সাথে যোগসূত্র তৈরী করতে পারছে।

২। হাসুন প্রাণভরে: বাড়ীর পরিবেশ দিনের অন্তত: কিছুটা সময় লঘু রাখার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন মজার বিষয় নিয়ে বাচ্চার সাথে কথা বলুন। হাসুন প্রাণমন খুলে। আপনার বাচ্চাকেও তা করতে দিন। হাসি এমনই মহৌষধ যা দুটি খুব দরকারী হরমোন নি:সরন করে— এন্ডরফিন এবং অক্সিটোসিন। এই দুটি হরমোন স্ট্রেস রিলিফের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। বাচ্চা যত বেশী হাসিখুশী থাকবে, জীবনে তত সহজে সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে।

৩। গ্যাজেট নয়: সারাদিনে বিভিন্ন রকম কাজে ব্যস্ত থাকি আমরা। এছাড়াও বর্তমানে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের অনেকটা সময় দখল করে বসে আছে গ্যাজেটস, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট। অনেকসময় আমরা আমাদের সন্তানদের কথাও মন দিয়ে শোনার ইচ্ছাপ্রকাশ করিনা এই সকল অভ্যাসগুলোর জন্য। আর ক্রমে বিরক্তিতে ভরে ওঠে ওদের মন। দূরত্ব তৈরী হয়ে যায় ওদের আর আমাদের মধ্যে। তাই যেটুকু সময় আপনি সন্তানের সাথে কাটাবেন বলে স্থির করেছেন( তা যদি পনের মিনিটও হয়) চেষ্টা করুন তা যেন গ্যাজেটবেষ্টিত না হয়। এর ফলে আপনার সন্তান মনের আনন্দে আপনার সাথে সময় কাটাতে পারবে।

৪। আবেগকে স্বাগত: অনেক সময় বিভিন্ন কারণে আপনার সন্তানের মন খারাপ থাকতে পারে। সেই মনখারাপ অনেকসময় রাগ বা আক্রোশে রূপান্তরিত হয়। আবার অনেকসময় বিধ্বস্ত হয়ে যায় তারা। চটজলদি এর জন্য কোনো সমাধান খুঁজতে যাবেন না। বরং সেই সময় ওর পাশে থাকার চেষ্টা করুন যত জরুরি কাজই আপনার থাকুক না কেন। কারণ এই সময় ওদের প্রয়োজন অভিভাবকদের। আর অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও সন্তানের সাথে সুসংযোগ রাখার সময় এইটি। ধৈর্য ধরে বসুন ওদের পাশে। নিজে আবেগপ্রবণ না হয়ে শান্তমনে শুনুন ওদের কথা যা আপাতভাবে যতই তুচ্ছ হোক না কেন। ওর কাঁদতে দিন মন খুলে। দেখবেন আস্তে আস্তে নিজেই ও ওর সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে শুধু আপনি পাশে আছেন বলে। অভিভাবকত্বের এটাই হলো সবচেয়ে বড়ো সাফল্য।

৫। শুনুন শুধু শুনুন: কখনও তা হতে পারে আধফোটা বুলি, কখনো বা বোকা বোকা জোকস কখনও আবার বন্ধুদের সাথে সাতঝামেলা…. যাই হোক না কেন আপনাকে তা মন দিয়ে শোনার অভ্যাস করতে হবে। তার সাথে সেই বিষয়ে কৌতুহলী প্রশ্নও করতে হবে। একটি উদাহরন দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
রিয়া এখন তার মা রমলার সাথে একদম কথা বলতে চায়না। তার ধারণা মা কে কিছু বলতে যাওয়া মানে সেগুলো মা তো শুনবেই না উপরন্তু সব কথাকে সেই পড়াশোনামূলক আলোচনায় নিয়ে যাবে। তেরো বছরের রিয়া তাই মায়ের সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে রমলারও প্রতি মুহূর্তে মেয়ের প্রতি অভিমান বাড়ছে। কোথাও যেন তার নিজেকে খুব অপ্রয়োজনীয় লাগছে। এরকম অবস্থায় রমলা আমার পরামর্শ নিতে আসেন। আমার কথামতন রমলা ধীরে ধীরে মেয়ের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে গল্পগুলো শোনা অভ্যাস করলেন। একসাথে ইংলিশ গান শোনা, সেই গায়ক গায়িকার সমন্ধে কৌতুহলী প্রশ্ন করা নিজের বয়:সন্ধির বিভিন্ন অভিজ্ঞতা মেয়ের সাথে ভাগ করে নেওয়া..এসবের মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করার কিছুদিন বাদেই রমলা বুঝতে পারলেন তাদের মা মেয়ের সম্পর্কের ভিত ক্রমশ: জোরালো হচ্ছে।

৬। ধীরে চলুন দিনের শেষে:
দিনের শুরু মানেই প্রচুর কাজের চাপ। স্কুল অফিস, টিফিনের প্রস্তুতি… এসবের মধ্যে আলাদাভাবে বাচ্চাকে সময় দেওয়া সত্যিই সম্ভব হয়না, কিন্তু দিনের শেষে একটু ধীর গতিতে চলুন আপনার সন্তানের সাথে। রাত্তিরে একটু সময় নিয়ে গল্প করতে করতে খাওয়া বা একসাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারায় ভরা আকাশ দেখতে দেখতে ব্রাশ করুন, অথবা ঘুমোতে যাওয়ার আগে একসাথে গল্পের বই পড়া… এতে শুধু সংযোগ বাড়ে তা নয়, মনের ক্লান্তিও উধাও হয়ে যায় যা পরবর্তী দিনের শুভসূচনার জন্য।

৭। মুহূর্তরা: বিভিন্ন রকম সমীক্ষায় দেখা গেছে আপনার সাথে আপনার সন্তানের সময় কাটানোর মেয়াদ সাধারনত: ৯০০ সপ্তাহ। তারপর তারা চলে যায় তাদের নিজস্ব বৃত্তে। তাই সবসময় গড়ে তোলার চেষ্টা করুন অমূল্য মুহূর্তদের। খেলাধূলো, গল্প, ছবি আঁকা এই সব কিছুর মধ্যে লিপ্ত থাকুক আপনার অভিভাবকত্ব।