আপনার টিনএজার সন্তানটিকে সামলাবেন কি করে?

গত কয়েকমাস ধরেই শালিনী তার তেরো বছরের মেয়ে মেঘনার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। শান্তশিষ্ট মেয়েটি হঠাৎ যেন বদলে গেছে। আয়নার সামনে ঘন ঘন নিজেকে দেখা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বুঁদ হয়ে যাওয়া, পড়াশোনায় অমনোযোগ আর কথায় কথায় বাবা মা’র সাথে তর্ক করছে মেঘনা। মেয়ের এই আকস্মিক পরিবর্তনে শালিনী কি করবে বুঝতে পারছেনা।
শালিনীর মতন অনেক অভিভাবকদের এটা একটা বিরাট সমস্যা। প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে তারা আসেন তাদের টিনএজ সন্তানদের সমন্ধে অভিযোগের লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে। কিন্তু এসব কিছুর আগে জেনে নেওয়া যাক কিছু তথ্য।
বারো পেরোনো মানেই আপনার সন্তানের কৈশোরের পথে হাঁটা শুরু হলো। এই সময় স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তের কারণে , বিভিন্ন রকম হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটারের প্রভাবে ওদের ব্যবহারে আসে পরিবর্তন। এই সময়ে ওদের মন থাকে আবেগে পরিপূর্ণ। তাই হঠাৎ রাগ বা কান্নাকাটিও খুব স্বাভাবিক এই বয়সে। শুধু তাই নয়, এই সময় থেকে আস্তে আস্তে ওদের মধ্যে তৈরী হয় ইনডিভিজুয়ালিটির ধারণা। মা বাবার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের মতন করে আত্মপ্রকাশের অদম্য ইচ্ছে ও প্রয়াস থাকে ওদের মনের মধ্যে। সেইসব কারণে বাবা মায়েদের সাথে শুরু হয় তাদের মতান্তর।

তাহলে কিভাবে সামলাবেন এই পরিস্থিতি?এই নিয়ে আপনাদের জন্য রইল জরুরি কিছু পেরেন্টিং পরামর্শ।

১। বদলে ফেলুন নিজেদের:
যেভাবে এতদিন পেরেন্টিং করে এসেছেন সেই খোলস থেকে বেরিয়ে আসুন। ওদের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলা, মারধর এসব একেবারেই বন্ধ করে দিন। শাসনের জন্য শান্ত গলাই যথেষ্ট।

২। ঘ্যানঘ্যান করবেন না:
রাতদিন ‘ পড় পড়’ বা ‘ তোর দ্বারা কিচ্ছু হবেনা’ এসব বলা বন্ধ করুন। ওরা বড় হচ্ছে, তাই বারবার এক কথা ওদের আরো জেদি আর তিতিবিরক্ত করে তোলে।

৩।ওদের ইচ্ছের সাথে থাকুন মাঝেমধ্যে:
আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসেন বলেই যে আপনার সন্তান তা ভালোবাসবে এমন কোন কথা নেই কিন্তু। হয়তো ইংলিশ রক মিউজিক ওর প্রিয়। মাঝে ওদের ইন্টারেস্ট এরিয়া গুলোতে উঁকিঝুঁকি মারুন। উৎসাহ প্রকাশ করুন ওদের ইচ্ছেগুলোতে। তাহলে দেখবেন ওরাও আপনাদের ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানাচ্ছে।

৪। ফ্যামিলি মিটিং:
আপনার সন্তান বয়:সন্ধিতে পৌঁছে গেলেই শুরু করুন ফ্যামিলি মিটিং। মাসে অন্তত: দুবার আপনারা বসুন সন্তানের সাথে। ওর বা আপনাদের ভালো লাগা বা খারাপ লাগা নিয়ে আলোচনা করুন, পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা করুন। ওদের মতামত নিন। এর ফলে ওরাও পারিবারিক বিষয়গুলো সমন্ধে ওয়াকিবহল হবে।

৫। নজরদারি:
মনে রাখবেন,,আপনার সন্তান বড় হওয়ার পথে এগোচ্ছে, বড় হয়ে যায় নি এখনো। তাই ওদের বন্ধুবান্ধবদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখুন। মাঝে মাঝে ওদের আসতে বলুন বাড়ীতে। সহজভাবে মিশুন, ওদের দৃষ্টিকোণ বোঝার চেষ্টা করুন।

৬। ওদের শুনুন মন দিয়ে:
আপনার টিনএজার সন্তানটির বক্তব্য মন দিয়ে শুনুন। আপনি যত বেশী ওদের কথা শুনবেন, তত উৎসাহ নিয়ে ওরা ওদের কথা বলবে। আর ততই মজবুত হবে ওদের সাথে আপনাদের সম্পর্ক।

৭। ফলো থ্রু:
আপনার টিনএজ সম্তানটিকে দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য এর থেকে ভালো উপায় আর নেই। একটি কেস স্টাডি বলি এক্ষেত্রে।
শ্রেয়া রোজই চান করে তার ভেজা টাওয়েলটা বারান্দায় মেলতে ভুলে যায়। প্রতিদিনই এই নিয়ে তার মায়ের সাথে খিটিমিটি লেগেই থাকে। অনেক সময় তীব্র ঝগড়ায় রূপান্তরিত হয় তা। শেষ পর্যন্ত শ্রেয়ার মা ফলো থ্রু’র সাহায্য নিলেন। চান করে বেরোনো মাত্রই নিয়ম করে শ্রেয়ার কাছে গিয়ে নরমভাবে তার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিতেন। দিন সাতেক করার পর থেকে শ্রেয়ার অভ্যাসই হয়ে গেল নিজের ভিজে টাওয়েল বাইরে মেলে দেওয়ার। আর কোনদিন বলতে হয়নি শ্রেয়াকে।

৮। তুলনা নয়:
টিনএজার সন্তানটিকে ভুলেও অন্যদের সাথে তুলনা করবেন না। এতে কাজ তো হবেই না বরং ও বিপরীত দিকে হাঁটতে পারে। সবসময় ভেবে দেখবেন, আপনার সাথে যদি সবসময় কেউ অন্য কারোর তুলনা করেন আপনার কেমন লাগবে। নিশ্চয় ভালো লাগবেনা। ওদেরও তাই ই হয়।

৯। স্মার্ট ফোন ব্যবহারের আধিক্যে রাশ টানুন:
ফ্যামিলি মিটিংএ ঠিক করে নিন গ্যাজেট টাইমিং নিয়ে। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় রাখুন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং র জন্য। নিজেরাও রাশ টানুন এই আসক্তি থেকে।

১০। নিজের দায়িত্বে পড়ুক:
পড়াশোনার সময় মুখের সামনে বসে থাকা বন্ধ করুন। ওদের রুটিন ওদেরই বানাতে বলুন। সপ্তাহে দু তিনদিন রিভিউ করুন ওদের পড়াশোনা। এতে ওরা উৎসাহ এবং আত্মবিশ্বাস পাবে।

১১। ফিটনেস জরুরি:
ওদের উৎসাহ দিন স্বাস্থ্যচর্চার জন্য। এরোবিক, যোগা, ব্রিদিং এক্সারসাইজ, ট্রেকিং এসবে অংশগ্রহণ করতে বলুন।

১২। অতিরিক্ত পকেটমানি বা উপহার নয়:
অযথা বেশী মাত্রায় উপহার দেওয়া বন্ধ করুন। একটা সময়ে আপনারা নিজেরা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না ওদের চাহিদা। তখনই তৈরী হবে সংঘাত। সবসময় চেষ্টা করুন অতিরিক্ত বিলাসব্যসনের মধ্যে আপনার সন্তানকে না রাখার। ওকে জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিকগুলো বুঝতে সাহায্য করুন।

আপনার পজিটিভ পেরেন্টিং আপনার টিনএজার সন্তানটিকে জীবন সম্পর্কে আশাবাদী করে তুলবে, ও সফল হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

(To get more consultations on this topic please register yourself to the ‘pashe achi’ portal of Medha Consultancy)