বছর চারেকের মিষ্টি মেয়ে শিন্জিনি দিব্যি মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায় আসে। স্কুলে টিফিন খেতে তার তীব্র অনীহা। মাঝে মাঝে এর জন্য মায়ের কাছে বকুনিও খায় সে। কিন্তু কিছুদিন ধরেই তার মা যখনই তাকে জিজ্ঞেস করে টিফিন খেয়েছে কিনা তখনই সে বলে ক্লাসের আন্টি ওকে টিফিন খেতে দেননি। প্রথম কদিন তার মা তা বিশ্বাস করত। ভাবত, হয়ত সময়মতন টিফিন শেষ করতে পারেনি সে। কিন্তু একদিন সে যখন বলল ক্লাস টিচার তার টিফিন খেয়ে নিয়েছেন তখন বেশ খটকা লাগল তার মায়ের। স্কুলে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে তারা বললেন শিন্জিনিকে বার বার বলা সত্বেও সে টিফিন বক্স খুলতেই চায়না। এটা শুনে তার মা বেশ অবাক! চার বছরের বাচ্চা কিভাবে শিখছে এই ধরণের মিথ্যে কথা বলা?
দ্বিতীয় ঘটনাটি অঙ্কুরের। অঙ্কুর খুব মিশুকে ছেলে। কিন্তু সে যখন গল্প করে তখন চারপাশের সবকিছু নিয়ে সে গল্প বানিয়ে ফেলে। কোনটা কল্পনা, কোনটাই বা বাস্তব তা মিলেমিশে এক হয়ে যায় তার কথায়। অনেক সময় এর জন্য অপ্রস্তুতেও পড়তে হয়েছে অঙ্কুরের মা বাবাকে। হাজার বকুনি সত্বেও তাকে না শোধরাতে পেরে বেশ হতাশ তার বাবা মা।
ওপরের দুটি ঘটনা মতন ঘটনার অভিজ্ঞতা অনেক মা বাবারই হয়েছে। বাচ্চারা অনেক সময় মিথ্যে কথা বলে। তাই এটা নিয়ে অনর্থক টেনশন, চিন্তাভাবনা না করে সবার আগে জানা দরকার বাচ্চারা মিথ্যে কথা বলছে কেন।
১। অনেক সময় বাচ্চারা নিজেদের দোষ- ত্রুটি ঢাকার জন্য মিথ্যে বলে থাকে।
২। অনেকসময় অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য (অ্যাটেনশন সিকিং) বাচ্চারা মিথ্যে কথা বলে।
৩। বড়দের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্যও অনেক সময় বাচ্চারা মিথ্যে কথার আশ্রয় নেয়।
৪। অনেকক্ষেত্রে বাচ্চা কল্পনার জগতে বিচরণ করে। সেসব ঘিরে তার কথোপথন চলে। যেমন একটি ছোট্ট বাচ্চা তার ক্লাস টীচারকে বলেছিল,’জানো ম্যাম.. আমার জন্মানোর পর থেকেই পা পর্যন্ত চুল ছিল’। এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে বাচ্চাটি তার কিছুদিন আগেই রেপান্জেলের গল্প পড়েছিল।
কবে থেকে বাচ্চা মিথ্যে বলা শুরু করে?
সাধারনত: দেখা যায় বাচ্চারা প্রায় তিন বছর বয়স থেকেই মিথ্যে বলা শুরু করে। বস্তুত: যখন ও বোঝে মা বাবা তার মনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনা, তখনই তার মিথ্যে বলার প্রবণতা তৈরী হয়।
চার থেকে ছ বছরের মধ্যে বাচ্চারা যখন মিথ্যে কথা বলে তখন তার মুখের অভিব্যক্তিতেই তা প্রকাশ পায়। মা বাবার পক্ষে খুবই সহজ এ ধরনের মিথ্যেগুলোকে চিহ্নিত করা।
যখন সে আরেকটু বড় হয় এবং তার মনের মধ্যে জটিলতার বৃদ্ধি হয় তখন মিথ্যেগুলো সহজভাবেই বলতে পারে। তখন মা বাবার পক্ষে সত্যি-মিথ্যের ফারাক বোঝা দুরূহ হয়ে ওঠে।
কিভাবে বাচ্চাকে সত্যি কথা বলার ব্যাপারে উৎসাহ দেবেন?
১। বাচ্চাকে বড় করুন অথরিটেটিভ পেরেন্টিং স্টাইলে। অর্থাৎ বাড়ীতে একটা নিয়মানুবর্তিতা বা গ্রাউন্ড রুল থাকবে যা প্রতি সদস্যই মেনে চলবে। সেক্ষেত্রে মিথ্যে কথা বলার ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে নিজেদেরও। স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চার মধ্যে সত্যি কথা বলার স্বাভাবিকত্ব তৈরী হবে।
২। অনেকসময় বাচ্চারা কল্পনার জগতের অনের ঘটনা বাস্তবজীবনের সাথে মিলিয়ে ফেলে। তাদের কথাবার্তায় ও তার প্রকাশ পায়। এটা আপাতভাবে মিথ্যাচার মনে হতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাচ্চাকে বকাবকি করবেন না। বরং হেসে বলুন, ‘বাহ্ কা সুন্দর গল্প’। এতে বাচ্চার অবচেতন মনে তৈরী হবে কোনটা বাস্তব কোনটা কল্পনা।
৩। বাচ্চারা অধিকাংশ সময় মা বাবার বকুনির ভয় মিথ্যে কথা বলে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে সত্যি কথা বলার সাহস দিতে হবে। মা বাবাদের প্রাথমিক কর্তব্য নিজেদের রাগকে সংযত করে তাকে বোঝান মিথ্যে বললে কেউ ভালবাসেনা। বরং বাচ্চা যদি সত্যি কথা বলে তার প্রশংসা সবাই করে। অবশ্যই তারপর কাউন্সেলিং র সাহায্য নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে একটি কেস স্টাডি বলি।
মিতার পাঁচ বছরের মেয়ে রুশা গ্লাসে করে দুধ খাচ্ছে। হঠাৎ কিছুটা দুধ চলকে পড়ে যায়। রুশা ভয় পেয়ে বলে উঠল’ মা আমাকে ভাই ঠেলে দিয়েছে, তাই দুধ পড়ে গেল’। মিতা খুব বুদ্ধিমতি মা। অন্য ঘরে থাকা ঘুমন্ত ভাই যে রুশাকে ঠেলতে পারেনা তা মিতা জানে। কিন্তু সে ওই নিয়ে সে কোনো তর্কেও গেলনা। বরং বলল
‘আমার মনে হয় তোমার হাত টা একটু নড়ে পড়ে গেছে দুধটা। এটা আমাদের অনেকেরই হতে পারে। তুমি একদম ভয় পেয়োনা। আমি বকবনা তোমাকে। বরং আমরা দুজনে মিলে এটা পরিষ্কার করে ফেলি। ‘
মিতা মেয়ের মুখে স্বস্তির আলো দেখতে পেল। মিতা তখন কাছে টেনে আদর করে বলল,’সত্যি বললে কোনো অসুবিধে নেই, কেউ বকেনা বরং সবাই ভালবাসে।’
৪। অনেক সময় টিভিতে দেখান কোনো কার্টুন প্রোগ্র্যামে মিথ্যে কথা বলার দৃশ্য থাকে। সে সব সময় বাচ্চাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিন কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক।
৫। বাচ্চাকে বিভিন্ন মরাল স্টোরিজের মাধ্যমে শেখান সত্যি কথা বলার অভ্যাস। মিথ্যেবাদী রাখাল বালকের গল্প তো আমাদের সবারই জানা।
৬। বাচ্চা একটু বড় হলে তার বন্ধুবান্ধবদের মনিটরিং করুন। বন্ধুদের থেকে বাচ্চারা অনেক কিছু নকল করে। তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময় রাখুন যেখানে বাচ্চার স্কুল বা কোচিং সংক্রান্ত ব্যাপারে ওর সাথে গল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। প্রয়োজনে ডিনারের পর দুজনে ওয়াকিং এ বেরোন। এতে বাচ্চার মনোভাব সঠিকভাবে বুঝতে আপনার সুবিধে হবে।
৭। বাচ্চাকে কখনই ‘মিথ্যেবাদী’ তকমা দেবেন না। বরং সে মিথ্যে কেন বলছে তা জানার চেষ্টা করুন। তা না হলে ও নিজেকে সংশোধন তো করবেইনা বরং ওর আত্মবিশ্বাস আরো কমে যাবে।
৮। অনেক সময় কিছু ব্যাপার গোপন রাখার জন্য বাচ্চা মিথ্যে বলে। এমনকি সেটা বাচ্চা যৌনপীড়নের শিকার হলেও। সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে বকা ঝকার পরিবর্তে আলাদাভাবে ওর সাথে বসুন। ওকে সাহস দিন সত্যি কথা বলার জন্য। ওকে এই বিশ্বাসটুকু দিন যে আপনারাই পারেন ওকে সঠিকভাবে গাইড করতে বা ওকে বিপদমুক্ত করতে।
৯। অনেকসময় আমরা বড়রা মজা করে মিথ্যে কথা বলে থাকি। যেগুলোকে ‘ওয়াইট লাইজ’ বা ‘সাদা মিথ্যে’ বলা হয়। সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার কিছু কিছু সময় মজা করে মিথ্যে বলা হয়। তাহলে বাচ্চার পক্ষে তার গুরুত্ব বোঝা সোজা হয়ে ওঠে।
১০। কখনো যদি দেখেন কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাচ্চা সত্যি কথার পক্ষে আছে উন্মুক্ত প্রশংসা করুন। এতে ওর উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস দুটোই বাড়বে।
বাচ্চাকে বড় করতে গেলে এসব নেগেটিভ বিহেভিয়ারের মোকাবিলা মাঝে মাঝেই করতে হয়। স্থিতিশীল মনে তার সলিউশন বার করুন। দেখবেন, আপনার বাচ্চার মধ্যে কত সোজাভাবে আপনি চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন।
Note: The above text is taken from the Bengali parenting book “Bhalo-bashay shaishab” (published from Dey’s Publishing) written by Parenting Consultant Payel Ghosh.