একটি বাচ্চার জীবনে তার স্কুল জীবন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়। এই স্কুল জীবন থেকেই শুরু হয় তার ভ্যালু এডুকেশন, সোশ্যালাইজেশন এবং সর্বোপরি আত্মিক উন্নতি। তাই মা বাবাদের সবসময়ই উচিত তাদের স্কুলজীবনের যত্ন নেওয়া। প্রাত্যাহিকভাবে কিভাবে সব কিছু সুষ্ঠভাবে করা যায় এবার তাই নিয়ে কিছু পেরেন্টিং পরামর্শ দেওয়া হল।
বাচ্চার রুটিন:
- স্কুল চলাকালীন প্রত্যেক মা বাবারই উচিত বাচ্চাকে একটি স্বাস্থ্যকর রুটিন ফলো করানো। বাচ্চার সাত আট ঘন্টা ঘুমেরও যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন অসময়ের ঘুম বন্ধ করা। আজকাল বিকেলে খেলাধূলোর রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে বলা যায়। ফলে বাচ্চা সন্ধ্যে অবধি ঘুমিয়ে থাকে। তার ফলে রাতে ঘুমোতে যথেষ্ট দেরী করে। এই অস্বাস্থ্যকর নিয়মে বাচ্চার কোনভাবেই সুস্থ মানসিকতায় বড় হতে পারেনা। তাই দুপুরবেলার ঘুমের সময় এক ঘন্টার বেশী কখনই হওয়া উচিত নয়। তাহলে রাতে খাওদাওয়ার পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারবে।
- বাচ্চাদের প্রতিদিন অন্তত ঘন্টা দেড়েক বাড়ীর বাইরে খেলাধূলোর সুযোগ করে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। খেলাধূলোতে যত বেশী এনার্জি খরচা হবে বাচ্চার মধ্যে তত অ্যাগ্রেসিভ বিহেভিয়ার কমবে। স্কুলের পড়াশোনাতেও মনসংযোগ বাড়বে।
- বাচ্চার টিফিনের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। সাধারনত: বাচ্চারা টিফিনে মুখরোচক খাবার পছন্দ করে। তাই সপ্তাহের শুরুতেই ঠিক করে রাখুন কবে কি টিফিন দেবেন। যেমন, কোনদিন দিলেন বাড়ীর বানানো গ্রিল্ড স্যান্ডুইচ, আবার কোনদিন কম তেলে বানিয়ে দিন ভেজিটেবল/ পনীর/ চিকেন ফ্রায়েডরাইস, কোনদিন আবার হয়ত দিলেন এগ রোল… একটু যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে টিফি ন দিলে ওদের মন আর স্বাদগ্রন্থি দুটোই ভালো থাকে। তবে প্রতিদিনই একটা করে গোটা মরসুমি ফল দিতে ভুলবেন না।
- বাচ্চাদের ইউনিফর্ম রোজই বেশ নোংরা হয়ে যায়। সম্ভব হলে তিনটে সেট কিনে রাখুন। আর প্রতিদিনই ফ্রেশ ইউনিফর্মে স্কুলে পাঠাবেন। বাচ্চাকে ছোট থেকেই পরিচ্ছন্নতার ওপর নজর দিতে শেখান, সেটা স্কুলের খাতা বই হোক বা পোশাক।
- প্রথম প্রথম বাচ্চাকে স্কুলের ব্যাগ গোছাতে সাহায্য করলেও কিছুদিন পর থেকে ওকে একাই সামলাতে দিন পুরো ব্যাপারটা। হয়তো প্রথম প্রথম একটু ভুলভাল করতে পারে কিন্তু আস্তে আস্তে ও বুঝে যাবে কিভাবে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে প্যাক করতে হয়।
- মাঝেমাঝেই ওর স্কুলের খাতাপত্র দেখুন। ক্লাসে কোথায় কী ধরণের ভুল করছে বা ক্লাসটিচার কী ধরনের কমেন্টস করছেন ওর কাজ সমন্ধে সেটা জানা বিশেষ প্রয়োজন। তবে নেগেটিভ কিছু দেখলে ওকে বকা ঝকা করার বদলে ওর পাশে দাঁড়ান। ওকে উৎসাহ দিন নতুনভাবে কাজটা করার জন্য।
- ছুটিছাটার সময় বাচ্চাকে অন্যরকম পড়াশোনা করান। ফিল্ড স্টাডি করাতে পারেন, হিস্টোরিক্যাল প্লেস বা মিউজিয়ামে নিয়ে যেতে পারেন, সুপারস্টোরে কিভাবে কাজকর্ম হয় সেসবের ওপরও ধারণা দিতে পারেন। বাচ্চার গতে বাঁধা পড়াশোনার বাইরেও জ্ঞান বাড়বে।
- স্কুলে টিচার্স ডে তে বা বন্ধুবান্ধবদের নতুন বছরে কার্ড দেবার সময় বাচ্চাকে নিজের হাতে তা বানাতে বলুন। প্রথম প্রথম আপনিও সাহায্য করতে পারেন। তারপর দেখবেন ও নিজেই খুব উৎসাহ পাচ্ছে এ বিষয়ে।
- বাচ্চার স্কুলের প্রজেক্টের কাজ ওকে নিজেই করতে দিন। আপনি বড়জোর ওকে দেখিয়ে দিতে বা আইডিয়া দিতে পারেন। অনেক মা বাবা বাচ্চা ভালো নম্বর পাবে বলে প্রফেশনাল লোকজনকে দিয়ে প্রজেক্ট করান। এটা একদম করবেন না। হয়ত কিছু নাম্বার কমই পাবে, তাতে সত্যিই কিছু এসে যায় কি? কিন্তু ও নিজে হাতে কাজ করার মধ্যে যে সম্যক ধারণা ও দায়িত্ববোধ তৈরী হবে তা ওকে পরবর্তী জীবনে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
- বাচ্চার সামনে কখনই স্কুল সংক্রান্ত কোন নেগেটিভ মন্তব্য করবেন না। এতে ওদের সরল মনে স্কুল সমন্ধে কোন মতবাদও চাপিয়ে দেবেন না। কোন বিষয়ে আপনার কোন ক্ষোভ থাকলে সে বিষয়ে আলাদাভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলুন। তাতে সমস্যার সমাধান সহজভাবেই হবে।
- এখনকার বাবা মা দের মধ্যে একটি প্রবণতা আছে ওয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে গ্রুপ তৈরী করে বিভিন্ন স্কুল ভিত্তিক বিষয়ে আলোচনা করা। এর অনেক কিছু পজিটিভ দিকও আছে। কিন্তু অনেক সময় তা খুব নিম্নমানের আলোচনায় রূপান্তরিত হয়। এসব বিষয় থেকে নিজেকে ফিল্টার করে নিয়ে চলুন। কারণ স্কুলের প্রতি আপনার নেগেটিভ ধারণা বাচ্চাদের ওপর পড়তে বাধ্য।
- বাচ্চার সান্ধ্যকালীন পড়ার সময় নির্দিষ্ট রাখুন। অনেকসময়ই দেখা যায় বাচ্চারা পড়ার সময়( সন্ধ্যে সাড়ে ছটা সাতটা নাগাদ) টি.ভি দেখছে বা বিভিন্ন অ্যাকটিভিটি ক্লাসে নাচ গান করছে। তারপর আট টা বা নটা নাগাদ পড়তে বসছে। অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যখন আপনি ওকে পড়তে বসাচ্ছেন তখন আপনারও আর ধৈর্য থাকছেনা। ফলে প্রোডাকটিভ পড়াশোনা বেশ কম অনুপাতেই হয়। চেষ্টা করুন বাচ্চাদের অ্যাকটিভিটি ক্লাসগুলো বিকেলের দিকে রাখার। পড়াশোনার সময়টা সন্ধ্যের মুখে রাখাই ভালো। কারন তখন বাচ্চার এনার্জি লেভেল বেশ হাই থাকে।
- মাঝে মাঝেই বাচ্চার স্কুলে সারপ্রাইজ ভিজিট দিন। বিশেষ করে যে সব বাচ্চারা স্কুল বাসে স্কুলে যায় তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। সুযোগ থাকলে ক্লাসটিচারের সাথেও মাঝে মাঝে দেখা করে নিন। ওনার ফিডব্যাক নিন আপনার বাচ্চার সম্পর্কে।
- স্কুলে পেরেন্টস টিচার্স মিটিং সব সময় অ্যাটেন্ড করার চেষ্টা করুন।স্কুল কর্তৃপক্ষও আপনার কাছ থেকে কী ধরনের কো অপারেশন চাইছেন সেটা জানাও খুব প্রয়োজনীয়।
- স্কুলে বাচ্চার হাইজিনের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। পর্যাপ্ত পরিমান জল খাওয়া বা সময়মতন টয়লেট যাবার ব্যাপারে বাচ্চাকে রিমাইন্ডার দিন। অনেকসময় বাচ্চারা স্কুল টয়লেটে যেতে চায়না। তারফলে অনেকসময়ই ইউরিন্যাল ট্র্যাক ইনফেকশন দেখা যায়। স্কুল ব্যাগ ওয়েট ওয়াইপস দিয়ে দেবেন। অনেকসময় টিফিন খাবার আগে ওরা হাত ধুতে ভুলে যায়। সেক্ষেত্রে এই জিনিসটি খুবই কার্যকরী।
- স্কুল থেকে ফেরার পর প্রতিদিন অবশ্যই কিছুটা সময় কাটাবেন বাচ্চার সঙ্গে। যারা বাইরে কাজ করেন তারা এই সময়েফোন করে কথা বলতে পারেন। পড়াশোনা ছাড়াও সামগ্রিকভাবে কেমন কাটল ওর সারা দিন সেটা জানার খুবই প্রয়োজন। অনেকসময়ই দেখা যায় বাচ্চা টিচারের বকুনি বা বল্ধুবান্ধবদের সাথে মনোমালিন্য বা পরীক্ষায় কম নাম্বার পেয়ে খুব মনখারাপ করে বাড়ী ফিরেছে। সেক্ষেত্রে তখন তাদের ভীষণ প্রয়োজন আপনাকে পাশে পাওয়া। দেখবেন, ওর মনখারাপ নিমেষে উধাও হয়ে গেছে।
বাচ্চার স্কুলজীবন অনেকধরনের অভিজ্ঞতার বুননে তৈরী। তাই সেই সমস্ত রকম অনুভূতিকে যাতে সে সফলভাবে অতিক্রম করতে পারে তার জন্য দরকার আপনার সান্নিধ্য ও পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। আপনার পজিটিভ পেরেন্টিংই ওর স্কুলজীবনের গতিপথকে করে তুলবে মসৃণ ও পেলব। আপনার যথার্থ গাইডেন্সেই ও ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে এক দায়িত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল নাগরিক।
Note: The above text is taken from the Bengali book “ইশকুলের মুশকিল আসান” (published from Dey’s Publishing) written by Parenting Consultant Payel Ghosh.
Thanks..a lot ma’am…
খুব দরকারি কিছু কথা। আশাকরি অনেকে উপকৃত হবেন।
আবার পড়লাম। সত্যি দরকারী,ভীষণ উপকৃত হলাম।
Thank you mam. Very useful tips we get from you.
Thank u for your beautiful & helpful tipes..